খোকা-আব্বাসের রেকর্ড ভাঙবে নতুন কমিটি?
নিউজ ডেস্ক : দীর্ঘদিন বিএনপির মহানগর শাখাটিকে নিয়ন্ত্রণ করা মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার যুগ কার্যত শেষ হয়েছে নতুন কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে।
তবে বিগত দুটি সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবশালী এই দুই নেতা যেখানে ‘ব্যর্থ হয়েছেন’, সেখানে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব ‘কতটা সফল হবেন’, তা নিয়ে আলোচনা এখন দলীয় পরিম-লে।
যদিও দলটির নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন, ব্যর্থতার বৃত্ত ভেঙে আকাক্সক্ষা পূরণে ভুমিকা রাখবে মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি। নতুন নেতৃত্ব আব্বাস-খোকার ‘ব্যর্থতার রেকর্ড’ ভাঙতে পারবে কী না-সেটিই এখন সময়ের প্রশ্ন।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অবশ্য মনে করেন ‘আশার প্রতিদান’ দেবে নতুন কমিটি।
রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আশা করি, নতুন কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন তারা মেধাবী ও পরিশ্রমী এবং তরুণ। দল ও দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরন করতে পারবেন তারা।’
তিনি বলেন, ‘সরকার বিএনপির নেতাকর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকারে যেভাবে বাধা দিচ্ছে, তাতে কমিটিকে প্রতিকুল পরিবেশে কাজ করতে হবে। এরপরও আমি আশাবাদী এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা সফল হবেন।’
গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি (আংশিক) ঘোষণা করে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির ঢাকা দক্ষিণের ৭০ সদস্যের এবং উত্তরে ৬৪ সদস্যের আংশিক কমিটি অনুমোদন করেন।
এর আগে ঢাকায় কমিটি ছিল একটিই। সিটি করপোরেশন ভাগ হওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও দুই ভাগের জন্য দুটি কমিটি করেছে।
এতে উত্তরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রাক্তন কমিশনার আব্দুল কাইয়ুম আর সাধারণ সম্পাদক হয়েছে আহসান উল্লাহ হাসান। অন্যদিকে দক্ষিণের সভাপতি করা হয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মহানগর বিএনপির আগের কমিটির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলকে। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করবেন কাজী আবুল বাশার।
তবে নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে দলীয় পরিম-লে বিশ্লেষণ চলছে কমিটি কেমন হলো তা নিয়ে। দলীয় নেতাকর্মীরা কমিটিতে তরুণদের বেশি মাত্রায় অন্তর্ভূক্তিকে সাধুবাদ জানালেও অনেক পরীক্ষিত নেতাকে অবমূল্যায়ন ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন তারা। পাশাপাশি উত্তরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া কাইয়ুম মহানগর রাজনীতিতে কতটা সক্রিয় থাকতে পারবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশি নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যা মামলার আসামি কাইয়ুম দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। শিগগির তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানও আত্মগোপনে অনেকদিন। পরিস্থিতি যখন এমন তখন তারা কীভাবে মহানগরের রাজনীতিতে দিকনির্দেশনা দেবেন তা নিয়েই মুলত সংশয়ে মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা।
তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন প্রতিকুল পরিবেশের কারণে এখন দূরে থাকলেও ‘সময় মতো’ ভূমিকা রাখবেন যারা নতুন কমিটিতে নেতৃত্ব পেয়েছেন।
‘মিথ্যা মামলায় যাদেরকে দূরে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে যাদেরকে এই কমিটিতে রাখা হয়েছে, তারা যে ভূমিকা রাখতে পারবেন না তা নয়। বরং তারাও একটি বড় ভূমিকা রাখবেন বলে বিশ্বাস করি। অতীত ইতিহাস বলে, শুধু কাছে থাকলেই ভূমিকা রাখা যাবে তা নয়।’
দীর্ঘদিন ধরে মহানগর বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়া আব্বাস-খোকা ছিলেন এতোদিন নেতাকর্মীদের কা-ারি। ১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বে আসা খোকা ২০১১ সালে দলের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখার আহ্বায়ক হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য তাকে দায়ী করা হলে ওই বছরের মার্চে স্বেচ্ছায় মহানগরের পদ ছেড়ে দেন তিনি।
এর কয়েক দিনের মাথায় অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ১৮ জুলাই মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব উন নবী খানকে সদস্য সচিব করে নতুন কমিটি করে বিএনপির হাইকমান্ড। কিন্তু সেই কমিটিও সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং দল গোছাতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে যখন নতুন কমিটি ঘোষণার দাবিতে অস্থিরতা, তখন মঙ্গলবার রাতে অপেক্ষাকৃত তরুণদের দিয়ে গড়া নতুন কমিটি ঘোষণা করে বিএনপি।
তবে কমিটি ঘোষণার পর ‘অবমুল্যায়নের কারণে’ আব্বাস-খোকার অনুসারীদের মধ্যে সেই পুরোনো দ্বন্দ্বই যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, নতুন এই কমিটিতে মির্জা আব্বাসের অনুসারীরা প্রধান্য পেলেও খোকার অনুসারীদের একেবারেই কোনঠাসা করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর বিএনপির দীর্ঘ সময়ের সভাপতি খোকা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত প্রাক্তন কমিশনার মোজাম্মেল হক মুক্তা (গোপীবাগ), প্রাক্তন কমিশনার লিয়াকত আলী (দক্ষিণ মৈসুন্দি), প্রাক্তন কমিশনার এম এ সামাদ (কোতোয়ালি), প্রাক্তন কমিশনার মোজাম্মেল হোসেন শিকদার (পোস্তাগোলা), বর্তমান কাউন্সিলর আবদুল কাদের (গেণ্ডারিয়া), এম শাহেদ মন্টু (সুত্রাপুর), শ্যামপুর থানা সভাপতি মজিবুর রহমান খান, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি হারুনুর রশীদ (কলতাবাজার) দীর্ঘদিন নগর রাজনীতিতে থাকলেও ঘোষিত কমিটিতে স্থান হয়নি তাদের। উত্তরের কমিটিতে সালাম সরকার (উত্তরা), জালালউদ্দিন (এয়ারপোর্ট), আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার (তেঁজগাও), হাজী রহমানের (দারুস সালাম) মতো প্রাক্তন কাউন্সিলর ও নেতারা স্থান পাননি। এ নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে খোকার অনুসারীদের মধ্যে।
আরো অভিযোগ উঠেছে, অনেক পরীক্ষিত ও যোগ্য নেতারা উপেক্ষিত রয়েছেন নতুন ঘোষিত এই কমিটিতে, জ্যোষ্ঠতাও লঙ্ঘন হয়েছে। তেমন একজন নবীউল্লাহ নবী। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী এই নেতা কমিটিতে সহসভাপতি পদ পেয়েছেন। নবীউল্লাহ নবীর উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে তুলনামূলক নবীন ইউনুস মৃধাকে। তেমনি সাজ্জাদ জহিরের উপরে ফরিদ উদ্দিন, নাসিমা আখতার কল্পনা, আবু মোতালেব; আরিফুর রহমান আরিফের উপরে তানভীর আদেল খান বাবু; মোশাররফ হোসেন খোকনের উপরে ইশরাত মির্জা ও নিতাই চন্দ্র ঘোষের নাম রয়েছে।
দক্ষিণের ১৯টি যুগ্ম সম্পাদক পদের তালিকায় কাউন্সিলর মকবুল ইসলাম টিপুর স্থান ১০ নম্বরে। তার উপরে নয়জনই মহানগরের রাজনীতিতে তার পরে এসেছেন। কমিটি ঘোষণার পর ক্ষুদ্ধ নবী উল্লাহ নবী এখন চিন্তা ভাবনা করছেন রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার। আরো অনেকেরও আছে সেই চিন্তা। কমিটি ঘোষণার পর নবী গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, শারীরিক অবস্থার কারণে যে কোনো সময়ে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন তিনি। শরীর ভালো যাচ্ছে না বললেও মূলত ক্ষোভ আর অবমূল্যায়নের কারণেই নবীর দল ছাড়ার চিন্তা।
বিএনপির মহানগর রাজনীতির সমীকরণ মেলানো, আব্বাস-খোকা অনুসারীদের দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তাদেরকে এক প্ল্যাটফর্মে আনা, নেতাকর্মীদের মনোবল ফিরিয়ে আনা এবং সর্বোপরি আন্দোলনে মাঠে থাকতে পারার চ্যালেঞ্জ- এসবের মতো অনেকগুলো বাধার সামনে দাঁড়িয়ে এখন সোহেল-কাইয়ুম। সবধরনের বাধা অতিক্রম করে অতীতের ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙবে, না কী ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে সেটি দেখা যাবে সময়ের আয়নায়।
তবে ঢাকা মহানগর বিএনপির দক্ষিণের সভাপতি এবং বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল আশাবাদী, ‘ভুমিকা রাখবে’ নতুন কমিটি।
তিনি বলেন, ‘ক্ষোভ, দুঃখ থাকবে না। বরং ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায়ে সবাইকে নিয়েই আগামীর আন্দোলন করা হবে। তাছাড়া যারা পদ পায়নি তাদের এখনও অনেক সুযোগ আছে। সে ব্যাপারে বিবেচনা করা হবে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নেত্রীর (খালেদা জিয়া) তত্ত্বাবধানে একটি সত্যিকার অর্থে ভালো কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেই কমিটিতে পরীক্ষিত সৈনিকদের স্থান দেয়া হয়েছে। কমিটির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে সমস্ত পদ এখনও শূন্য আছে সেখানেও কাউকে নেয়ার সুযোগ থাকবে।’
স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘ভালো কমিটি হয়েছে। নবীন-প্রবীণদের সমন্বয়ে এই কমিটি আগামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে বলে আমার বিশ্বাস।’ রাইজিংবিডি