সরাইলে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু স্বামীর সাক্ষাৎ ভাগ্যে জুটেনি খাদিজার
---
সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি : খাদিজা বেগম। বয়স মাত্র ১৫ বছর। পিতা দরিদ্র কৃষক আলী আকবর। বাড়ি উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের যুগি পাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে কোন রকমে নানা টানা পোড়নের মধ্য দিয়ে চলছিল তাদের ৭ সদস্যের পরিবার। ৪ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে খাদিজা সবার বড়। কষ্টেশিষ্টে খাদিজা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছিল নোয়াগাঁও পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সমাপনী পরীক্ষার আগেই প্রবাসী স্বামীর সন্ধান পেয়ে শিশু খাদিজাকে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার। বিয়ে হয় মুঠোফোনে। শিশু হয়ে যায় গৃহবধু। যে সময়ে খাদিজার পড়ালেখা ও খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকার কথা। সেই সময়ে না বুঝলেও তার কাঁদে তুলে দেওয়া হয় যৌথ সংসারের দায়িত্ব। দারিদ্রতাই কাল হয় ওই শিশুর। অট্রালিকার মালিক স্বামী বাপ্পীর স্ত্রী কৃষকের মেয়ে। এ যেন কোন ভাবেই মানতে পারছিলনা শ্বশুড় বাড়ির লোকজন। তাই বিয়ের পর থেকেই তার উপর শ্বাশুড়ি ননদ সহ স্বামীর বাড়ির লোকজন কর্তৃক নানা নির্যাতন নিপিড়নের অভিযোগ করছে খাদিজার স্বজনরা। বিয়ের পর কোন দিনও স্বামীকে কাছে পায়নি খাদিজা। সবশেষে গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্বামীর বাড়ি থেকে খাদিজার লাশ উদ্ধার করেছে সরাইল থানা পুলিশ। খাদিজার পরিবার বলছে খাদিজাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর স্বামীর স্বজনদের দাবী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে খাদিজা। আর পুলিশ বলছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। পুলিশ, নিহতের পরিবার ও স্থানীয় লোকজন জানায়, মাত্র পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী খাদিজা। বিদ্যালয়ের নথিপত্র অনুসারে খাদিজার জন্ম ২০০২ সালের ৮ মে। গত ৮ মাস আগে উভয় পরিবারের সম্মতিতে শিশু খাদিজার সাথে বিয়ে হয় সরাইল সদর ইউনিয়নের বড্ডাপাড়া গ্রামের আলী আকবর মিয়ার কুয়েত প্রবাসী ছেলে বাপ্পী মিয়ার (৩০)। বাপ্পী এর আগেও উচালিয়া পাড়ায়, চুন্টা ও নাসিরনগরে বিয়ে করেছিল। তাদের সংসার বেশী দিন ঠিকেনি। সবশেষ বাপ্পী মুঠোফোনে তাড়াহুড়া করে বিয়ে করে খাদিজাকে। সরাররি স্বামী স্ত্রী কেউ কাউকে দেখেনি। উভয় পক্ষের অভিভাবকরা মিলে বাপ্পীর স্বশরীরে অনুপস্থিতিতেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। খাদিজাকে তুলে দেওয়া হয় শ্বশুড় আলী আকবরের হাতে। স্বামীর অনুপস্থিতিতেই সংসার করতে থাকে খাদিজা। কিন্তু সেখানে ভাল যাচ্ছিল না তার দিনকাল। শ্বশুড় আলী আকবর, শ্বাশুড়ি শিরিন বেগম (৪৫), ননাশ লাকী আক্তার ও দেবর মনিরের সাথে বনিবনা হচ্ছিল না তার। তারা প্রায়ই কারনে অকারনে খাদিজাকে নির্যাতন করত। তাকে বাবার বাড়িতে যেতে দিত না। এক সময় খাদিজা তাদের অসহ্যের কারন হয়ে পড়ে। অতিসম্প্রতি মা সহ স্বজনরা খাদিজাকে নিতে আসলে তারা মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। গতকাল ভোর ৪টায় মুঠোফোনে খাদিজার মামা কবিরকে শিরিন বেগম খাদিজার মৃত্যুর খবর জানান। ফজরের আগেই লাশ ফেলে তাদের বিল্ডিংয়ের চারিদিকে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছে পরিবারের সকলে। সকালে প্রতিবেশীরা খাদিজার মৃত্যুর ঘটনাটি নিশ্চিত হয়। খাদিজার বাবা মা ও স্বজনরা এসে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। স্বামীর দ্বিতীয়তলা ভবনের নিচ তলার একটি কক্ষে খাটের উপর পড়ে আছে খাদিজার নিথর দেহ। তারা পুলিশকে খবর দিলে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে খাদিজার লাশ উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। সকাল ১১টায় ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় জনমানব শুন্য ভবনটির চারিদিকে তালা। পাশের পুকুর ঘাটে পড়ে রয়েছে ভিজা সেলোয়ার ও কামিছ। আশপাশের লোকজনের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। চোখেমুখে ভীতির চাপ। দূর থেকে উঁকিঝুকি মারছে। কেউ কাছে আসছে না। হঠাৎ করে দৌড়ে আসে ওই গ্রামের বাসিন্ধা রাহমাতুল্লিল আল-আমীন দাখিল মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্রী বৈশাখি বেগম ও ৬ষ্ট শ্রেণির ছাত্রী রুজি বেগম জানায়, এ বাড়ির বউকে রাইতে গলা টিপ্পা মাইরা লাইছে। বিকাল ৪টায় খাদিজার লাশ তার বাবার বাড়িতে পৌঁছলে হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মেয়ের লাশ দেখে বারবার জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছেন বাবা আলী রাজা। বুক চাপড়িয়ে চিৎকার করছেন মা মাঞ্জুমা বেগম। তাদের অভিযোগ শ্বশুড়, শ্বাশুড়ি, ননাশ ও দেবর মিলে মেয়েটাকে হত্যা করেছে। এ অপরাধের বিচার চাই তারা। খাদিজার মা মাঞ্জুমা বেগম বলেন, মেয়েটা এখানের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছি। গতকাল ভোরে আমাকে বাপ্পী ফোনে জানায় খাদিজাকে ফোনে পাচ্ছে না। আর তার বাবা জানায় খাদিজা অসুস্থ্য। আমারা বড্ডাপাড়া গিয়ে দেখি বাড়ির বিদ্যুৎ গ্যাসের লাইন ছিঁড়ে সকলেই পালিয়েছে। স্বামীর সাথে কোন দিন সাক্ষাতই হয়নি। এর আগেই নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হল মেয়েটি। নোয়াগাঁও পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আশরাফুল আলম মৃধা বলেন, খাদিজা ২০১৬ সালে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার্থী। তার জন্ম তারিখ ২০০২ সালের ৮ মে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই তাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। সরাইল থানার এস আই রাকিব হাসান বলেন, খাটে লম্বাভাবে শুয়া অবস্থায় ছিল খাদিজার লাশ। গলার ডান দিকে নিচে কালচে একটা জখমের চিহ্ন ছিল। অফিসার ইনচার্জ রুপক কুমার সাহা বলেন, ময়না তদন্ত করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।