মানব উন্নয়ন সূচকে ৩ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর ১৪২তম অবস্থানে থাকলেও এবার ১৩৯তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে নেপাল (১৪৫তম) এবং পাকিস্তান (১৪৭তম)। ভারত ১৩১তম হয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও মাথাপিছু আয় বাদে এইচডিআই গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়সহ সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ গতবারের চেয়ে উন্নতি করেছে। গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ ‘মধ্যম মানব উন্নয়ন’ ক্যাটাগরিভুক্ত দেশ। এমন উন্নতিতে জাতিসংঘ মনে করছে, বাংলাদেশ একটি রোল মডেল হতে পারে। নব্বইয়ের পর থেকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নে সন্তুষ্ট জাতিসংঘ।
বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন- ২০১৬’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য দেয়া হয়। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) ও বাংলাদেশে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) যৌথভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৫ সালের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্বের ১৮৮ দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আয় ও সম্পদের উৎস, বৈষম্য, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রবাহ, যোগাযোগ, পরিবেশের ভারসাম্য ও জনমিতির তথ্য বিশ্লেষণ করে এই মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করে ইউএনডিপি।
জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী শূন্য থেকে একের (০-১) মধ্যে বিভিন্ন দেশের মানব উন্নয়ন সূচকের (এইচডিআই) স্কোর প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের এইচডিআই স্কোর ছিল দশমিক ৫৪৫, যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৫ সালে হয়েছে দশমিক ৫৭৯। ২০০০ সালে এইচডিআই স্কোর ছিল দশমিক ৪৬৮ এবং ১৯৯০ সালে দশমিক ৩৮৬। এবারের তালিকায় সবচেয়ে ভাল অবস্থানে থাকা নরওয়ের এইচডিআই স্কোর শূন্য দশমিক ৯৪৯ এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের স্কোর দশমিক ৩৫২। এইচডিআই সূচকে এ বছর বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে ঘানা ও জাম্বিয়া। এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা (৭৩), মালদ্বীপ (১০৫), ভারত (১৩১) ও ভুটান (১৩২)। সূচকের অন্তর্ভুক্ত ১৮৮ দেশকে অতি উন্নত, উন্নত, মধ্যম ও নিম্ন মানব উন্নয়নের চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ রয়েছে মানব উন্নয়নের ‘মধ্যম’ দেশের স্তরে।
ইউএনডিপির এবারের মানব উন্নয়ন সূচকের মূল প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য মানব উন্নয়ন’। ১৯৯০ সাল থেকে এ সূচক তৈরি করে আসছে ইউএনডিপি। এবারের সূচক সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানব উন্নয়নে বেশ উন্নতি হলেও সমতা নিশ্চিত হয়নি। ফলে এখনও সমাজে বিপুলসংখ্যক সুবিধাবঞ্চিত মানুষ রয়ে গেছে। বৈশ্বিক এ প্রতিবেদনটিতে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা সূচকে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়। সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচীরও প্রশংসা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচক নির্ণয়ে মূল মানদ- হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নাগরিকদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল, শিক্ষা ও মাথাপিছু জাতীয় আয়। যেসব দেশের মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বেশি, শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নত ও মাথাপিছু আয় বেশি, সেসব দেশ এ সূচকের তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। সূচকে সবার শীর্ষে রয়েছে নিশীথ সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত নরওয়ে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক ও সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরই কেবল এশিয়ার দেশ।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। বিশেষ অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ। বিশেষ বক্তা হিসেবে ছিলেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ড. সেলিম জাহান। প্রতিবেদনের প্রধান লেখক ড. সেলিম জাহান অনুষ্ঠানে বলেন, এসডিজির লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে কেউ যাতে পিছিয়ে না থাকে। এটাকে ভিত্তি ধরেই মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের পর থেকে ২০০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠে এসেছে। কিন্তু এখনও বিশ্বে দারিদ্র্য আছে, অসমতা রয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত অভিঘাত রয়েছে। বিশ্বে এখনও প্রতি তিন জনের একজন মানব উন্নয়ন সূচকে কাক্সিক্ষত মানের নিচে। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা। এর প্রভাবে আমাদের যে ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ব এগিয়ে না এলে তা আমাদের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, এবারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উন্নতির পেছনে প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি বড় ভূমিকা রেখেছে। গত আট বছর ধরে শিক্ষার পেছনে বর্তমান সরকার যে বিনিয়োগ করেছে তার ফসল হচ্ছে এটি। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের ফলে এ উন্নতি সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম জিইডি প্রধান নাকিব বান মাহবুব, ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।