টানা ২১ দিন ধরে অচল রুয়েট
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ২১ দিনেও ‘৩৩ ক্রেডিট’ প্রথা বাতিল দাবির আন্দোলন নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট কাটেনি। শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পর, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শাস্তির দাবিতে চলছে শিক্ষকদের টানা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি।
ফলে সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি ছাড়াও টানা ১৫ কার্যদিবস সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া নবাগত শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর দিন থেকে আন্দোলন শুরু হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। এ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশন জটে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন।
তবে সঙ্কট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক আন্দোলনে যুক্ত থাকা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তারা বলছেন, ‘আন্দোলনের মুখে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিলেও এতে নাখোশ প্রশাসন। ফলে কৌশলে শিক্ষক সমিতিকে ব্যবহার করে, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পেছনে হাত রয়েছে স্বয়ং রুয়েট ভিসির। তদন্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বাছাই করে শাস্তি দিতে এ পথ বেছে নিয়েছে প্রশাসনের কর্তারা।’
শিক্ষার্থী বলেন, প্রশাসন চাইলে কাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারেন। কিন্তু তারা তা করছেন না। শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছেন। আন্দোলনে বেশি সক্রিয় থাকা কয়েকজনকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়ার পথ বের করতে শিক্ষক সমিতিকে দিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছেন।
শিক্ষার্থীরা আরো জানায়, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। তবে বেশিরভাগ বিভাগের শিক্ষকরা তা গ্রহণ করেনি। শিক্ষার্থীরা যেকোনো সময় শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাইতেও প্রস্তুত রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বুধবার কার্যালয়ে গিয়েও রুয়েট ভিসি প্রফেসর মোহা. রফিকুল আলম বেগের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বৃহস্পতিবার রুয়েটে সাপ্তাহিক ছুটি এবং শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে ভিসির মোবাইলে একাধিকবার কল করে এবং এসএমএস দিয়েও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে শিক্ষক সমিতির দু’জন নেতা জানান, আন্দোলনে বিশেষ রাজনৈতিক দলের উস্কানি এবং দাবি মানার পর ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ক্যাম্পাসে এসে যেসব কথা-বার্তা বলেছেন, তা শিক্ষক এবং প্রশাসনের জন্য অপমানজনক। শিক্ষক কমিউনিটি এধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ক্ষুব্ধ। তাদের অ্যাক্টিভিটিস গ্রহণযোগ্য নয়, সেটার প্রতিবাদ জানিয়ে মূলত কর্মসূচি। সেটাকে কৌশলে ‘আন্দোলনে উস্কানিদাতা’ শব্দে উল্লেখ করছেন শিক্ষকরা।
শিক্ষক সমিতির জরুরি সভা: তবে শিক্ষক সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে প্রশাসন দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করায় এবং তদন্তে অগ্রগতি হওয়ায় সন্তুষ্ট শিক্ষকরা। শনিবার সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষক সমিতির জরুরি সভা আহ্বান করেছে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ মুস্তাফী। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি এবং সামাজিক মাধ্যমে দুর্ব্যবহার করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সব শিক্ষার্থীর বিষয়ে নয়, সীমালঙ্ঘনকারী এবং উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে কর্মসূচি পালন করছি।’
প্রফেসর নীরেন্দ্রনাথ বলেন, ‘গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি চলছে। এর মধ্যে আমরা ভিসির সঙ্গে সাক্ষাত করে দাবি জানিয়েছি। প্রশাসন আমাদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছেন, সেখানে তদন্ত চলছে। সে বিষয়ে খোঁজ রাখছেন শিক্ষকরা। শনিবার সমিতির জরুরি সাধারণ সভা রয়েছে, সেখানে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে। আশা করছি- তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতির দিকে নজর দিয়ে রবিবার থেকে শিক্ষকরা ক্লাসে ফেরার বিষয়ে ইতিবাচক মতামত দেবেন।’
জানা যায়, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীদের পরবর্তী বর্ষে উত্তীর্ণের জন্য বাধ্যতামূলক ৪০ ক্রেডিটের মধ্যে নূন্যতম ৩৩ ক্রেডিট অর্জনের নিয়ম করা হয়। নিয়ম চালুর পর ২০১৫ সালের আগস্টে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমাতে সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টাকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। পরে দাবি আদায় ছাড়াই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় দেড় বছর পর আবারও একই দাবি নিয়ে ২৮ জানুয়ারি টানা আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে তারা বিক্ষোভ মিছিল, গণস্বাক্ষর, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি করে। ৩১ জানুয়ারি আন্দোলন দমাতে আবারও প্রশাসন দু’টি সেশনের ক্লাস-পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ১ ফেব্রুয়ারি ওই দু’টি সেশনের শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ জারি করে। ৪ ফেব্রুয়ারি দিনভর আন্দোলনের পর বিকেল থেকে ভিসির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। এতে অবরুদ্ধ হয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অন্তত ২৫ শিক্ষককে নিয়ে কার্যালয়ে রাত কাটায় ভিসি প্রফেসর মোহা. রফিকুল আলম বেগ। পরদিন ভিসি অবরুদ্ধ অবস্থায় একাডেমিক কমিটির জরুরি সভা ডেকে দাবি মেনে নেয় প্রশাসন।
তবে ওইদিন সন্ধ্যায় শিক্ষক সমিতির জরুরি সভায় আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে কটুক্তির অভিযোগ আনা হয়। শিক্ষকরা আন্দোলনে সীমালঙ্ঘনকারী, উস্কানিদাতা ও সামাজিক মাধ্যমে কটুক্তিকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ ভিসির সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনে সীমালঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি জানায়। দাবির প্রেক্ষিতে প্রশাসন জড়িতদের চিহ্নিত করতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে পরিস্থিতি সন্তোষজনক না হওয়ায় শিক্ষকদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকায় কার্যত অঘোষিত অনির্দিষ্টকালের ছুটি চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।