সোমবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ইং ৮ই ফাল্গুন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ

জীবনের সুখ মা-বাবাকে বাদ দিয়ে নয়

AmaderBrahmanbaria.COM
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৭

কাছের বন্ধু বিয়ে করেছে। তাকে বললাম, এই বয়সে বিয়ে না করলে হতো না? বন্ধু চোখ কপালে তুলে বলল, ২৪ বছর কি কম বয়স? তারপর ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বিড়বিড় করে বলল, আসলে পালিয়ে বিয়ে করা বোধ হয় ঠিক হয়নি। আর ও আমাকে কত ভালোবাসত তোকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। বললাম, ভালোবাসত মানে? এখন বাসে না! বন্ধু জবাব দিল, বুঝতে পারছি না। বিয়ের পর এই চার দিনের মধ্যে কেমন যেন ওলটপালট দেখি সব। বললাম, উল্টো করে গাছে ঝুলালে সব ঠিক দেখবি। দাঁড়িয়েই যখন উল্টো দেখিস। তোকে উল্টো করলেই সব ঠিকঠাক দেখবি।
বন্ধু পাত্তা দিল না আমার কথার। বলল, আমার মনে হয় বিয়ে করলে সবাই এমন উল্টো দেখে। একটু থেমে আবার বলল, শুনবি না, কেন বললাম, ও কত ভালোবাসত আমাকে? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বন্ধু বলতে থাকল। ও রাতে ঘুমানোর আগে আমার কলের অপেক্ষা করত। আমার সঙ্গে কথা বলে তারপর ঘুমাত। একদিন আমার মোবাইলে ক্রেডিট ছিল না। বড় ভাইয়ার মোবাইলটা ধার চাইলাম। তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন। ভার হুংকার মানে তো জানিস। তিনি বললেন, এত রাতে আবার কীসের কল? ঘুমাতে যা, নাইলে খবর আছে। ফোন দিতে না পেরে সারা রাত ছটফট করে কাটল। সকালে ঘুম চোখে মোবাইলে ব্যালেন্স নিয়ে কল দিলাম। ও কি বলল জানিস? আমার সঙ্গে কথা না হওয়ায় ও সারা রাত ঘুমায়নি।
বন্ধু আরও কিছু বলতে চাইল। আমি থামিয়ে দিলাম। বললাম, ও আচ্ছা। আর তাতেই বুঝে গেলি, কত ভালোবাসে তোকে!
না দোস্ত, এখন মনে হয় সেটা আমার ভুল ধারণা ছিল।
আমি সরু চোখে বন্ধুর দিকে তাকালাম।
বন্ধু বলল, বিয়ের পর তিন রাত পার হলো। আমি ওকে ফোন দিলে বলে, খবরদার ফোন দিবা না আমাকে। এর মধ্যেই আমাকে বড় বিপদে ফালাইছ তুমি। আমার ত্রিসীমানায় আসলে তোমার খবর আছে। আগে তোমার ঘরে তোলো। সেটা না পারলে তোমার খবর আছে। নফল নামাজ পড়ে তোমার বিরুদ্ধে বিচার চাইব আল্লার কাছে।
নিজের অজান্তেই আমার কাশি চলে আসল। সত্যিই অবাক হলাম। বললাম, পালিয়ে বিয়ে করলি তোরা। তোদের তো একসঙ্গে থাকার কথা। ফোনে কথা হয় কেন?
বন্ধু বলল, কাজী সাহেব রিক্তার (বন্ধুর প্রেমিক) মামার দিকের আত্মীয়। আমি জানতাম না সেটা। কাজী অফিসে রিক্তা ঘোমটা টেনে বসেছিল। ঘোমটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখলে এমন বিপদ হতো না। আমি ওকে বলেছিলাম দরকার নাই ঘোমটার। রিক্তা বলল, কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। কিন্তু কবুল হওয়ার পর যখন কাবিননামায় সই হলো, তারপর ওর লজ্জা চলে গেল। ঘোমটা খুলে রিক্তা চেহারা বের করল। আমি তাকিয়ে দেখছিলাম সদ্য বিয়ের পর একটা মেয়ের চেহারা কেমন হয়!
আমার রোমান্টিক মুডের ভেতরে কাজী বাম হাত দিলেন। চেয়ার থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বললেন, আরে তুমি রিক্তা না? পড়িমরি করে আমি কাজীর ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু রিক্তা আসতে চাইল না। বলল, আমি মামার বাসায় যাব। বললাম কেন? রিক্তা বলল, আমার ভয় করছে। তোমার ওপর ভরসা পাচ্ছি না। কাজী আংকেল জেনে গেছেন। এখন পালাতে গেলে আরও বিপদ বাড়বে।
আগে জানতাম বিয়েতে একজন কাজীর ভূমিকা থাকে বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত। আমার কপালে দেখি উল্টো। কাজী সাহেব আমার বিয়ে পরবর্তী জীবনেও ইন্টারফেয়ার করছেন। তিনি রিক্তার মামাকে ফোন দিলেন। আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম, দৌড়ে পালাব কিনা? নিজের কাছে সদুত্তর পেলাম না। ঝটপট কিছু বাংলা ছবির দৃশ্যের কথা মনে আনার চেষ্টা করলাম। নায়ক তার প্রেমিকার হাত ধরে কীভাবে ভিলেন মামার সামনে দাঁড়িয়ে। অবশ্য এই পরিস্থিতি থেকে রিক্তাই আমাকে মুক্তি দিল। বলল, তুমি পালাও। আসল কাজ তো হয়েই গেছে। আল্লাহই রক্ষা করবে।
তারপর থেকে রিক্তার সঙ্গে আমার দেখা নেই। আজ চার দিন হলো আমি একজন পরিচিতের মেসে আছি। রিক্তা আমাকে ফোনে বলেছে, সে ওর মামার বাসায় আছে।
বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, রিক্তা কি সেখানে কোনো চাপের মধ্যে আছে?
বন্ধু বলল, না চাপে নাই। তবে প্রথমবার ফোন দিয়ে ভড়কে গিয়েছিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম কেন?
বন্ধু বলতে থাকল, কাজী অফিসের ঘটনার পর আমি সারা দিনে আর ফোন দেওয়ার সাহস পাইনি। মনে মনে ভাবছিলাম, রিক্তা হয়তো চরম অপমানিত আর অপদস্থ হচ্ছে। সাহস করে ফোন দিলাম সন্ধ্যায়। কল ধরার পর আমি কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। খুব কষ্ট হলো রিক্তার জন্য। বললাম, রিক্তা তোমাকে মেরেছে? আমাকে ভালোবেসে তোমার কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। আমি সরি।
রিক্তা আমাকে ধমক দিল। বলল, কী আবল-তাবল বলছ? আমি কাঁদব কেন। মামি কাঁদছিলেন। ওনার দাঁতে অনেক ব্যথা। মাড়ি ফুলে গেছে। আমি ওনার গালে গরম ছ্যাঁকা দিচ্ছিলাম। তুমিও ফোন দেওয়ার সময় পেলে না। আচ্ছা যাক, আমি সরে এসেছি সেখান থেকে। আর শোন, আমি এক রকম তোমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছি। এই ঘটনার জন্য তোমাকে দায়ী করে সব দোষ তোমার ঘাড়ে দিছি। বলেছি, তুমি আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়ার নাম করে কাজী অফিসে নিয়ে গেছ। আমি কিছুই জানতাম না আগে থেকে। আমি এগুলো না বললে আমাকে জ্যান্ত কবর দেবে। আমি আব্বু-আম্মুর একমাত্র মেয়ে। এটা আমার বেঁচে থাকার কৌশল মনে করবা। পরে তোমাকে ভালোবেসে এগুলো শোধ করে দেব। ভালো খবর হচ্ছে, মামা আব্বু-আম্মুকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। তুমি তোমার ফ্যামিলি ম্যানেজ করো। যা করবার দ্রুত করো।
বন্ধু শুকনো মুখে আমাকে এই কথাগুলো বলল। তার মুখ থেকে আর কথা বের হচ্ছে না। অথচ এই ছেলেই প্রেম করার সময় কত বাণী দিত। এখন বিয়ে করে যে মাইনকার চিপায় পড়ছে সেটা তার চেহারায় স্পষ্ট। আমি বললাম, সর্বশেষ কি কথা হয়েছে রিক্তার সঙ্গে?
বন্ধু বলল, ফোন দিলে ধমকায়। কারণ, আমি এখনো আমার ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তারা ঘটনা জানছে। কিন্তু আমাকে ফোন দিচ্ছে না। শুধু বড় ভাইয়া ফোন দিয়ে অনেক হুংকার দিয়েছেন। বলেছেন, আমাকে পেলে হাড্ডি মাংস আলাদা করে ফেলবেন।
আমি বন্ধুকে বললাম, পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ভালোবাসার সফল মঞ্চায়ন করেছিস। কিন্তু তার জন্য নিজের ফ্যামিলিকে উপেক্ষিত করে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিস তা সামলাবি কীভাবে? তারপর সিরিয়াস কিছু কথা বললাম বন্ধুকে। বললাম, ঘুমানোর সময় তোর ফোন না পেয়ে সারা রাত রিক্তা ঘুমোতে পারে নাই। সেটা থেকে বুঝলি রিক্তা তোকে কত ভালোবাসে! আর তোর এই অঘটনের জন্য গত তিন রাত তোর বাবা-মা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। তোর দেওয়া কষ্টে তাদের চোখে পানি এসেছে। এটা বিশ্লেষণ করবি কীভাবে? এত স্বার্থপর কেন তুই? একটা সম্পর্কের স্বীকৃতি দিতে গিয়ে, নিজের আপনজনের নাড়ির সম্পর্কে টান ধরালি কেন? এখন যদি সেটা ছিন্নও হয় সেই দায়টা তোর।
জীবনে চলার পথে কাউকে ভালোবাসবি, প্রেম করবি, কারও হাতে হাত রেখে জীবন পার করার সিদ্ধান্ত নিবি। সেটা নেওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে তোর। কিন্তু সেটা মা-বাবাকে উপেক্ষা করে নয়, বন্ধু। কোনো মা-বাবাই চান না সন্তানের প্রেমহীন জীবন। সে তার জীবনসঙ্গী খুঁজে পাক সেটাই তারা চান। ছেলে একদিন বড় হবে, বিয়ে করবে—প্রত্যেক মা-বাবা এটাই ভাবেন। কিন্তু এটা ভাবেন না, কোলেপিঠে বড় করা সন্তানটি নিজের জীবনের সুখ খুঁজতে তাদের অগোচরে তাদের আগলে রাখা ভালোবাসায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাহস করবে। এক মমতায় জড়াতে গিয়ে মানুষ যখন অন্য মমতার বাঁধন কাঁটতে শুরু করে তখন সে বড় ভুল করে।
আরও বললাম, শোন, রিক্তা যদি তোমার জীবনের জন্য সুখ হয়, সেটা তোর মা-বাবার জন্যও সুখের কারণ হবে। শুধু সেটা তাদের বোঝার সুযোগটা দিতে হবে। পালিয়ে বেড়ালে সেটা তারা বুঝতে পারবেন না।
বন্ধু এবার জড়িয়ে ধরল আমাকে। দেখলাম, সত্যিই তার বুকে অনেক কান্নার মেঘ। আমার কথায় সেটা বৃষ্টি হয়ে ঝরল। আমি থামালাম না তাকে। জিজ্ঞেস করলাম, মা-বাবাকে মিস করেছিস খুব, তাই না? বন্ধু নিরুত্তর রইল। আমি জবাবের অপেক্ষা করলাম না। সন্তানের শেষ আশ্রয় তার বাবা-মা। ভালোবাসার বাতাসে ঘুড়ি যে আকাশেই উড়ুক না কেন, সুতোর টান ছাড়া ঘুড়ি বেসামাল হয়ে যায়। সেই সুতোর টানই নাড়ির টান। যেটা পৃথিবীতে নীরব এক প্রতিষ্ঠিত সত্য।
আমি বন্ধুকে বললাম। শোন, তোর বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়েছে। তোর বড় ভাইয়ের কাছে তোর এই অঘটন শুনে প্রথম দিন তারা দুজন মিলে পারিবারিকভাবে তোকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেছিল। তুই ছাড়া দ্বিতীয় দিন তোর মা থাকতে পারছিল না। তোর বাবাকে বলেছিল, মাহিনকে এনে দাও, ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। কিন্তু তোর বাবা সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বলেছিলেন, এমন ছেলে আমার দরকার নাই। ওকে আমি বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখতে চাই না। তৃতীয় দিন তোর শোকে দুজনই দিশেহারা হয়ে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, যেভাবেই হোক তোকে খুঁজে বের করতে। তারা তোকে মেনে নেবেন। তুই তোর জীবনের সুখ খুঁজে নে। কিন্তু সেটা যেন তাদের বাদ দিয়ে না হয়। তাহলে যে মা-বাবা তাদের সারা জীবনের সুখ হারাবেন!