নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার পাংশায় পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে নয়াদিল্লির। ভারতের পক্ষ থেকে গত মাসে একটি কারিগরি দল এই প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পর দুই দেশ কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। ব্যারাজের জলাধারে উজানের দেশ ভারতের অংশে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না তা সমীক্ষা করবে কমিটি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কমিটি নিজ নিজ দেশের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। কয়েক বছর চিঠি চালাচালির পর ভারত গত মাসে এই বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। পররাষ্ট্র ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অন্যদিকে আগামী মাসের মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ ও সম্মতির বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে। ভারতও এ বিষয়ে কাজ করছে। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই বৈঠক করেছে এবং শেখ হাসিনার সফরে এই বিষয়ে একটি ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ গত বৃহস্পতিবার নিজ দফতরে এ বিষয়ে সকালের খবরকে বলেন, আগে গঙ্গা ব্যারাজ বলা হলেও এখন এই প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ করা হয়েছে। কারণ গঙ্গা নদী বাংলাদেশে পদ্মা নামেই বয়ে গেছে।
পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজে ভারত ইতিবাচক উল্লেখ করে পানি সচিব বলেন, বাংলাদেশ ব্যারাজ নির্মাণ করার বিষয়ে ভারতের সঙ্গে কয়েক দফায় চিঠি চালাচালির পর ভারতের পক্ষ থেকে গত মাসে একটি প্রতিনিধি দল এসে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। ভারতের কারিগরি দলের সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের কারিগরি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ভারত তাদের কমিটি গঠন করে পাঠিয়েছে এবং আমরা কমিটি গঠন করেছি। কারিগরি কমিটি পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের কারিগরি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশের পর পাংখা থেকে মাথাভাঙ্গা নদীর মুখ পর্যন্ত ৮৫ কিলোমিটার জুড়ে প্রবাহিত নদীর একপাশে বাংলাদেশ এবং অন্যপাশে ভারত। বাংলাদেশ-ভারতের কারিগরি কমিটি এই অংশের বিষয়ে জরিপ ও সমীক্ষা চালাবে। বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও পাবনার সুজানগর উপজেলার মাঝখানে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজে যে জলাধার নির্মাণ করা হবে, সেই জলাধারের পানি ভারতের অংশে কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না সে বিষয়টিই মূলত খতিয়ে দেখবে কারিগরি দল। এই প্রকল্পের বিষয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের করা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পাংশার যে জায়গায় গঙ্গা-পদ্মা ব্যারাজ করা হবে সেখানে যে জলাধার সৃষ্টি হবে তা ভারতের অংশে যাবে না। কারণ ভারতের অংশ যেখানে শেষ তার প্রায় ৯০ কিলোমিটার ভাটিতে পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ হবে। পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজের স্থান থেকে ভারতের অংশ পর্যন্ত প্রায় ২০ মিটার উচ্চতা। আর ব্যারাজের জলাধারের উচ্চতা হবে ১০ মিটার।
কারিগরি সাব গ্রুপের বাংলাদেশের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। সদস্যরা হলেন-পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া উইংয়ের মহাপরিচালক, আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার উপদেষ্টা ও সাবেক যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন, জেআরসি সদস্য মো. জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প পরিচালক মোতাহার হোসেন, সিইজিআইএসের উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. মমিনুল হক সরকার, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পিন্টু কানুনগো, আইডব্লিউএমের ড. ফারুক আহমদ মহিউদ্দিন ও জেআরসির পরিচালক মো. মোফাজ্জল হোসেন। গত ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এই কমিটি গঠন করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের সদস্যকে (আরএম) প্রধান করে আট সদস্যের কারিগরি সাব গ্রুপের গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের প্রধান প্রকৌশলীসহ বাকি সদস্যরা হলেন-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কেন্দ্রীয় জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি থাকবেন। গত ২১ নভেম্বর ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন কমিটি গঠনের চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ক্রমান্বয়ে গঙ্গা নদীর পানির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। বিগত ৬৭ বছরের মধ্যে ফারাক্কা পয়েন্টে এ বছর শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের নদীগুলোর ৪০ ভাগ পানি আসে এই নদী দিয়ে। এতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার ১২৩টি নদী শুকিয়ে যায় এবং জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদ হুমকির মুখে পড়ে। এ ছাড়া লবণাক্ততা থেকে প্রায় ছয় কোটি মানুষের জন্য গঙ্গা (পদ্মা) নদীতে ব্যারাজ নির্মাণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
গঙ্গা ব্যারাজ করার জন্য ১৯৬০ সাল থেকে ইতোপূর্বে পাঁচবার সমীক্ষা করার পর এবার রাজবাড়ী জেলার পাংশা এবং পাবনা জেলার সুজানগরের মাঝখান দিয়ে পদ্মা নামে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ১ কিলোমিটার ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। ব্যারাজের ওপর ব্রিজ করা হবে। এতে দুটি অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।
অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ গঙ্গার পানির সদ্ব্যবহার করবে। কিন্তু বাংলাদেশ ১৮ বছরেও ব্যারাজ নির্মাণ করতে না পারায় পানির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। আগামী ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ না করতে পারলে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ সমীক্ষায় অনুযায়ী, গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১১ মিটার উচ্চতার ২৯০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণযোগ্য জলাধার সৃষ্টি করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে সেচ, ইলিশসহ মত্স্য সম্পদ উন্নয়ন, জলবিদ্যুত্ উত্পাদন, নৌপরিবহন, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও বনজ সম্পদ রক্ষায় ব্যবহার করে সাত বছরের মধ্যেই ব্যয়ের টাকা উঠে আসবে বলে সমীক্ষায় বলা হয়।