নিজস্ব প্রতিবেদক : নীতিমালা অনুসরণ ছাড়াই ব্যয় করায় গত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্ষতি হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। অডিট অধিদপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সূত্র মতে, দৈনন্দিন ফ্লাইট কার্যক্রম সচল রাখতে বিমান এয়ারলাইনসের বেশকিছু ব্যয় অনুমোদন ছাড়াই নির্বাহ করা হয়, পরবর্তীতে যার অনুমোদন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে যথাযথভাবে ১৩৩টি লেনদেনে আর্থিকবিধি অনুসরণ না করায় আপত্তি তুলেছে অডিট অধিদপ্তর। যথাযথ আর্থিকবিধি অনুসরণ না করে সংঘটিত এসব লেনদেনে পাঁচ বছরে বিমানের ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭১০ কোটি টাকায়।
সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। এ বৈঠকেই আর্থিকবিধি অনুসরণ না করে অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি উঠে আসে।
আর্থিকবিধির বাইরেও ডিপোর্টি যাত্রী-সংক্রান্ত, প্যাক্স মিল, গ্রাউন্ড ও প্যাক্স লে-ওভার, হারানো ব্যাগেজে ক্ষতিপূরণ, ক্রয় প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটি ও বাজেটের অতিরিক্ত ব্যয়ে আপত্তি জানিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। এ রকম ৫৭৪টি আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা বলে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির সভাপতি শওকত আলী বলেন, ‘আমরা চাই না, কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে অডিট আপত্তি থাকুক। এ কারণে আমরা এসব আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ বিমান-সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ করেছি।’
বিমান বাংলাদেশ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বিমানের মোট উত্থাপিত অডিট আপত্তির সংখ্যা সাত হাজার ৩৪১। এসব আপত্তির মধ্যে মীমাংসিত আপত্তির সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫৯৯। আর অমীমাংসিত রয়ে গেছে এক হাজার ৭৪২টি। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয়ের অডিট আপত্তির সংখ্যা ৬৪৫, অভ্যন্তরীণ স্টেশনের ৪৩০ ও দূতাবাস অডিট অধিদপ্তরের আওতাধীন বৈদেশিক স্টেশনগুলোর আপত্তির সংখ্যা ৬৬৭।
বিমানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অডিট আপত্তিগুলো উত্থাপনের পর পরই বিমানের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে প্রামাণিক ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক জবাব দেয়া হয়। প্রাথমিক জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তি নিষ্পত্তির সংখ্যা দাঁড়ায় নগণ্যে। পরবর্তীতে সাধারণ আপত্তিগুলো দ্বিপক্ষীয় সভা, অগ্রিম ও ডিপি
আপত্তিগুলো ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তির চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সুপারিশ করা সব আপত্তি নিষ্পন্ন হয় না।
সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বিমানে এক হাজার ৮৮টি আপত্তি ওঠে। এসব আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২৩৫ কোটি পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে এক হাজার ৫১টি আপত্তি মীমাংসা হয়, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ২২২ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। আর ৩৭টি অডিট আপত্তি অনিষ্পন্ন থাকে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১২ কোটি ৯৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা।
১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৫৩৫টি অডিট আপত্তি ওঠে, যেখানে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৬২ কোটি ৭৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এসব আপত্তির মধ্যে এক হাজার ৪৬৪টি নিষ্পন্ন হলেও অনিষ্পন্ন থাকে ৭১টি। নিষ্পন্ন না হওয়া এসব আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ২৩ হাজার টাকা। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এক হাজার ৮৮৯টি অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৮১ কোটি ৩৫ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এসব আপত্তির মধ্যে নিষ্পন্ন হয় এক হাজার ৬১৯টি। অনিষ্পন্ন ২৭০টি আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৫২ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিমানে এক হাজার ১৪৬টি অডিট আপত্তি ওঠে, যাতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৩৭৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এসব আপত্তির মধ্যে নিষ্পন্ন করা হয় ৯২৪টি ও অনিষ্পন্ন থাকে ২২২টি। অনিষ্পন্ন আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৬০৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ওঠা ৯৭৬টি অডিট আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এসব আপত্তির মধ্যে ৪৬৩টি নিষ্পন্ন হয়, আর অনিষ্পন্ন থাকে ৫১৩টি। অনিষ্পন্ন আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ৭৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ডিপোর্টি-সংক্রান্ত আপত্তির সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪টি ডিপোর্ট আপত্তি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ ১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
ডিপোর্টি-সংক্রান্ত অডিট আপত্তি প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সংসদীয় কমিটিতে জানায়, বিমানবন্দরে কোনো যাত্রীকে বোর্ডিং পাস ইস্যু করার আগে তার সব তথ্য পরীক্ষা করা হয়। ইমিগ্রেশনের ছাড় না পাওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট যাত্রীকে উড়োজাহাজে ভ্রমণের সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে গন্তব্যে পৌঁছে কোনো যাত্রী ডিপোর্টি হলে তার দায়দায়িত্ব বর্তায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের ওপর। কিন্তু আইএটির বিধি অনুযায়ী, জাতীয় এয়ারলাইনস হিসেবে ডিপোর্টি হওয়া যাত্রীদের ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ বিমান বাধ্য।
অডিট আপত্তিতে বলা হয়, বিমানের বহরে পুরনো উড়োজাহাজ থাকায় অনেক সময় যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ে। ফলে ফ্লাইট বিলম্ব হলে যাত্রীদের হোটেলে রাখতে হয়। একই সঙ্গে যাত্রীদের খাবারেরও ব্যবস্থা করতে হয়। বিষয়টি কারিগরি হওয়ায় এতে অভিযুক্তদের দায়িত্ব নির্ধারণ সম্ভব হয় না।
বিমানের ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়েও অডিটে আপত্তি রয়েছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বিমানের ক্রয় কার্যক্রম এর পরিচালন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। ফ্লাইট চলাচল সাবলীল রাখতে বিমানের নিজস্ব ও পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদিত ক্রয়নীতি অনুসরণ করা হয়।
সর্বশেষ ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৭০৭টি অডিট আপত্তি ওঠে। এসব আপত্তির মধ্যে নিষ্পন্ন হয় ৭৮টি। অনিষ্পন্ন অডিট আপত্তিতে জড়িত অর্থের পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।