নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের কাজীপাড়া মহল্লার একটি খোলা মাঠ থেকে ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে শিশু উদ্ধার করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সাড়ে তিন থেকে চার মাস বয়সী নাম-পরিচয় না জানা সেই ছোট্ট শিশুটি বর্তমানে পরম মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠছে জেলার সরকারি শিশু পরিবারে।
শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক শিশুটির নাম রেখেছেন ‘সম্প্রীতি’। নিষ্পাপ ও মায়াবী চেহারার এই সম্প্রীতির দিকে তাকালে যে কোনো দুর্বৃত্তের হৃদয়ের মরুভূমিতেও যেন বৃষ্টি নামবে! শিশু পরিবারে এসে যারাই সম্প্রীতিকে দেখছেন আর লালন-পালনের জন্য তাকে দত্তক নিতে চাইছেন। কিন্তু শিশু পরিবার এখনো সম্প্রীতির প্রকৃত বাবা-মায়ের খোঁজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৪ অক্টোবর ভোরে পৌরশহরের কাজীপাড়া মহল্লার মিয়া বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি খোলা মাঠে ঘাসের উপর কে বা কারা ওই শিশুটিকে ফেলে রেখে যায়। পরে ফজর নামাজ শেষে মুসল্লিরা শিশুটিকে দেখতে পান। সেখান থেকে স্থানীয় এক নারী শিশুটিকে তুলে নিয়ে তার বাড়িতে যান।
এরপর ঘটনার খবর পেয়ে সদর মডেল থানা পুলিশ শিশুটিকে ওই নারীর কাছ থেকে থানায় নিয়ে আসে। তখন শিশুটিকে অনেকেই নেয়ার জন্য বলেন, কিন্তু পুলিশ প্রকৃত বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে শিশুটিকে সরকারি শিশু পরিবারের রেখে আসে।
যদিও শিশুটিকে সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ছোটমণি নিবাসে রাখার কথা ছিল, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো ছোটমণি নিবাস না থাকায় শিশুটির ঠাঁই হয়েছে শহরের মেড্ডার তিতাসপাড়াস্থ সরকারি শিশু পরিবারে।
মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত সম্প্রীতিকে শুধুই গুঁড়ো দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। কয়েকদিন আগে সম্প্রীতির বুকে কফ জমে গিয়েছিল। তবে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মনির হোসেনের চিকিৎসায় সম্প্রীতি এখন পুরোপুরি সুস্থ।
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে সরকারি শিশু পরিবারে গিয়ে দেখা যায়, শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা খাতুন মাতৃস্নেহে সম্প্রীতির মুখে খাবার তুলে দিয়ে মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন।
খাবার খাওয়ানো শেষে শিশু পরিবারের কারিগরি প্রশিক্ষক সুলতানা লাইজু ঘরের বিছানায় সম্প্রীতির সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে ওঠেন। বার বার সম্প্রীতির গালে-মুখে চুমু এঁকে দিচ্ছিলেন লাইজু। সম্প্রীতিকেও তখন বেশ হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
কারিগরি প্রশিক্ষক সুলতানা লাইজু বলেন, সম্প্রীতি খুবই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। সে সারাদিন তত্ত্বাবধায়ক ম্যাডাম ও আমার সঙ্গেই থাকে। সম্প্রীতি এখানে মাতৃস্নেহেই বড় হচ্ছে। তবে ফুটফুটে এই শিশুর এমন করুণ পরিণতিতে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক রওশন আরা খাতুন বলেন, মূলত সম্প্রীতির বয়সী শিশুদের জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ছোটমণি নিবাস রয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো ছোটমণি নিবাস না থাকায় তাকে শিশু পরিবারে রাখা হয়েছে। আমি যখন সন্তান সম্ভাবা ছিলাম তখন মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যদি কন্যা সন্তানের মা হই তাহলে তার নাম রাখবো সম্প্রীতি। সেই সূত্র ধরেই শিশুটিকে সম্প্রীতি নাম দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, সদর মডেল থানা পুলিশ সম্প্রীতিকে শিশু পরিবারে রেখে যাওয়ার পর থেকেই অসংখ্য মানুষ ওকে দত্তক নিতে চাইছে। কিন্তু আমরা ওকে প্রকৃত বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতে চাই।
বাবা-মায়ের সন্ধান চেয়ে লোকাল ক্যাবল চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। যদি সম্প্রীতির বাবা-মায়ের সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মঈনুর রহমান বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি ১৪ অক্টোবর ফজরের আযানের সময় বোরখা পরা এক নারী শিশুটিকে ফেলে রেখে যায়। তবে আমরা এখনো জানতে পারিনি কেন ওই নারী শিশুটিকে ফেলে রেখে গেছে।
বিষয়টি এখনো তদন্ত করা হচ্ছে। শিশুটিকে দত্তক নেয়ার জন্য অসংখ্য মানুষ আমাকে প্রতিদিন ফোন করছে কিন্তু আমরা এখনো তার প্রকৃত বাবা-মায়ের অপেক্ষায় আছি। যদি বাবা-মাকে না পাওয়া যায় তাহলে সরকারি নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে শিশুটিকে কারো না কারো হাতে তুলে দেয়া হবে।