সৌদিতে এখন মাটি কামড়ে টিকে থাকাটাও মুশকিল!
নিজস্ব প্রতিবেদক : আলা (২২) ও আয়েশা (৪০)। এই দুই সৌদি নারী বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন মদিনার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে। আগে শুধুমাত্র টেলিফোন অপারেটর হিসেবে নারীরা সৌদি আরবে কাজ করলেও এখন হাউজ কিপিংসহ বিভিন্ন সেক্টরে তাদের দাপুটে অবস্থান চোখে লাগার মতো।
আলা ও আয়েশার সহকর্মী সবাই প্রবাসী। স্থানীয়ভাবে যাদের বলা হয় আজনবি। যার অধিকাংশই আবার বাংলাদেশি। আপাতদৃষ্টিতে এই ছবিটাকে খুবই সৌহার্দ্যের মনে হলেও এর মাঝেই উঁকি দিচ্ছে প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ার নানা শঙ্কা। রয়েছে চাকরি হারানোর ভয়ও।
ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচি ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নে সৌদি নারীদের বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে দেশটির সরকার। খবর বার্তা ২৪’র।
রক্ষণশীল অবস্থা থেকে উত্তোরণ ঘটছে এখানকার নারীদের। নিজেদের ক্ষমতায়নে এই নারীরাই বদলে দিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশটির চেহারা।
আর তাদের জায়গা করে দিতেই লাগামহীন ছাঁটাইয়ের শিকার হচ্ছেন প্রবাসী কর্মিরা। কঠোর বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকারও হচ্ছেন তারা।
ধরা যাক আবু সালেহ’র কথা। ১৮ বছর ধরে সৌদি প্রবাসী আবু সালেহ (৪৩) কাজ করেন মদিনার খুব কাছের গ্র্যান্ড মারকিউ নামের পাঁচ তারকামানের হোটেলে।
১৮ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি বর্তমানে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পান, মাত্র এক বছর কাজে প্রবেশ করে পদ-পদবীতে কয়েক ধাপ নিচে থেকেও আলা ও আয়েশারা পান তারচে’ ঢের বেশি পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা।
আরও : যে রং ঘুম কেড়ে নেয়!
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার হাজিরপাড়া গ্রামের মৃত আবদুল বারেকের ছেলে আবু সালেহ ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রুম বয় হিসেবে। বর্তমান সৌদি সরকারের ভিশন অনুযায়ী প্রবাসীরা ১২টি পেশাগত শ্রেণিতে বিন্যাস অনুযায়ী শীর্ষ কোনো পদে চাকরি কিংবা স্বর্ণ ও মোবাইলসহ নানা ব্যবসায় থাকতে পারবেন না।
এতদিন আবু সালেহরা যেভাবে পদন্নোতি পেয়ে ধাপে ধাপে ওপরে উঠেছেন- সেই পথটাও ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে এসেছে।
কেবল নারীর ক্ষমতায়নই নয়, সৌদি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ভিশন নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশটির সরকার। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলেও তা পূরণ করা হচ্ছে প্রবাসীদের জায়গাগুলোতে। প্রবাসীদের ওপর চাপানো হচ্ছে বাড়তি করের বোঝা। যে কারণে সবক্ষেত্রেই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন প্রবাসীরা।
কথা হয় গ্র্যান্ড মারকিউ হোটেলের সহকারী এক্সিকিউটিভ হাউস কিপার চাঁদপুরের মতলবের বাসিন্দা শফিকুল ইসলামের (৪০) সঙ্গে।
তিনি জানান, যারা একটু ভালো চাকরি-বাকরি করেন; এমন অনেকেই আগে পরিবার নিয়ে বসবাস করলেও বিরূপ পরিস্থিতির মুখে স্বজনদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ছুটিছাটা না পেলেও তিন থেকে ছয় মাসের জন্যে স্ত্রী, সন্তানকে কাছে রাখবেন সেটাও বেশ জটিল করে দিয়েছে দেশটির সরকার। পরিবারের স্বজনদের জন্যে ভিজিট ভিসা ফি যেখানে ভারতীয় নাগরিকদের জন্যে মাত্র ৩০৫ রিয়াল সেখানে বাংলাদেশিদের জন্য ২ হাজার রিয়াল।
এত টাকা ফি, তার ওপর যাতায়াতসহ বাড়তি খরচের কারণে ভিজিট ভিসায় পরিবারের স্বজনদের নির্দিষ্ট দিনের জন্যে নিয়ে আসাটাও কষ্টকর। এখানে চাকরি করে আর সুখ নেই। পবিত্র মদিনাতে থাকি, ছুটি পেলে মক্কায় যেতে পারি- বলতে পারেন এই সান্তনা নিয়েই কাজ করি।
হোটেলে সিনিয়র সুপারভাইজার টাঙ্গাইল বাসাইলের সালাহউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, সমানে যে দিন আসছে; তাতে করে শিগগির এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। ১৮ বছর এখানে থাকার পর দেশে মানানসই কাজ পাবেন কিনা সে চিন্তাতেও তার মতো অনেকের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
দীর্ঘ দেড় দশক থাকার পর চলমান পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে উঠেছে ঢাকার সাভারের মোক্তার হোসেন। লন্ড্রি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোক্তার জানালেন, এখানে এখন মাটি কামড়ে টিকে থাকাটাও মুশকিল।
সহসাই তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। হজের পর তার মতো অসংখ্য মানুষকে এ দেশ ছাড়তে হবে, উপায় নেই- জানান মোক্তার হোসেন।