লাইলাতুল কদর ও ই’তিকাফ
মুফতী আজিজুল হক ইয়াকুবী: পবিত্র মাহে রমজানের দ্বিতীয় দশকও বিদায় নিল। শুরু হয়েছে শেষ দশক। এ দশক হলো জাহান্নাম থেকে মুক্তির। জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য মুমিনের হৃদয় এখন আকুল হয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে। সফল নামাজ ও তাওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছে মুমিনরা। কারণ, রমজান পেয়েও ক্ষমা না পাওয়া সত্যি হতভাগা হওয়া। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, যারা রমজান মাস পেয়েও নিজেকে পাপমুক্ত করতে পারল না, তারা ধ্বংস প্রাপ্ত।’
পবিত্র এ মাসের শেষ দশকেই রয়েছে বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। যে রাতে বান্দার গুনাহ ক্ষমা করানোর অপার সুযোগ রয়েছে। এ রাত সারা বছরের সমস্ত রাত অপেক্ষা সর্বাধিক মর্যাদাশীল, বৈশিষ্ঠ্যমণ্ডিত ও মহিমান্বিত বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল ক্বদর। এ রাতের মর্যাদা এতই বেশি যে এর মর্যাদা বর্ণনা করে একটি পূর্ণ সুরা নাজিল করেছেন আল্লাহ তায়ালা। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, যখন লাইলাতুল ক্বদর উপস্থিত হয়, তখন হযরত জিবরাঈল আমীন একদল ফেরেশতাসহ পৃথিবীতে নেমে আসেন। তাদের সাথে সবুজ রঙের একটা ঝাণ্ডা থাকে যা কা’বা শরীফের উপর উড্ডীন করে দিয়ে ফেরেশতাগণ পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েন এবং আল্লাহর বান্দা-বান্দিরা যে যেখানে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে, বসে, আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে, দুআ করে, তাদেরকে সালাম করে, তাদের সাথে মুসাফাহা করে এবং তাদের দুয়ায় আমীন আমীন বলতে থাকে। (বায়হাকী)।
লাইলাতুর কদরে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য : ১. এ রাতে মহা-গ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম অবর্তীর্ণ হয়েছে। ২. এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ৩. এ রাতে হযরত জিবরাঈল(আঃ) এক দলসহ জমীনে অবতরন করেন। এছাড়াও এ রাতটিই ভাগ্য রজনী। যে রাতের কথা সুরা দুখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি এ রাতে ইবাদত করবে আল্লাহ তায়ালা তার অতীতের সব (সগিরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও সওয়াব লাভের খাঁটি আশায় লাইলাতুল কদরে কিয়ামুল্লাইলে (তাহাজ্জুদে) অতিবাহিত করবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। তওবার মাধ্যমে কবিরা গুনাহও মাফ করিয়ে নেবার এক অনন্য সুযোগ লাইলাতুল কদর।
লাইলাতুল কদর কোন রাত তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এ মহা মূল্যবান রাতকে আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ হেকমতের কারণেই অনির্দিষ্ট রেখেছেন। তবে তা অনির্দিষ্ট হলেও আমাদের জন্য অনেকটাই নির্দিষ্ট। কেননা লাইলাতুল ক্বদর সাধারণত রমাযান মাসেই হয়েই থাকে। তা হলে বাকি এগারো মাস থেকে নির্দিষ্ট হয়ে গেল একমাস। একমাসের মধ্যে আবার শেষ দশকেই হওয়া নির্দিষ্ট। তা হলে আরও সীমাবদ্ধ হয়ে গেল । এরপর এ দশ দিনের মধ্যে আমার বেজোড় রাত্রে হওয়া নির্দিষ্ট। এই সম্পর্কে রাসূল(সাঃ) বলেন, “তোমরা রমাযানের শেষ দশকে বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ করো।’ (বুখারি)। তাই রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোই লাইলাতুল কদরের সম্ভাবনার রাত। প্রতিটি মুমিনের উচিত সে রাতগুলোতে বেশি বেশি ইবাদত করা।
লাইলাতুল কদরে পড়ার মতো একটি বিশেষ দুআর কথাও হাদিসে এসেছে। হজরত আয়শা (রা.) রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমরা যদি লাইলাতুল ক্বদর পাই তাহলে কি করবো? উত্তরে রাসূল(সাঃ) বললেন, বলবে “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া ফা’’ফু আন্নি।” অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি পরম ক্ষমাশীল ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ কর,কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও’।(তিরমিযি)।
আরও : আর্জেন্টিনার ভক্ত মাশরাফি
বুখারি শরিফের হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমাযানের শেষ দশদিন এলে লুঙ্গি মজবুত করে বেঁধে নিতেন এবং রাত্রি জাগরণ করতেন। অর্থাৎ ইবাদত বন্দেগীতে কাটাতেন এবং পরিবারের লোকদেরকেও জাগাতেন।(বুখারী)। এহেন সম্মানিত-মহিমান্বিত ও বরকতময় রাত পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মুসলমানেরই প্রবল চেষ্টা থাকা উচিত।
লাইলাতুল কদও পাওয়ার সর্বোত্তোম পন্থা হল ইতিকাফ করা। কারণ ইতিকাফকারী ঘুমিয়ে থাকলেও তার আমলনামায় ইবাদতের সওয়াব লেখা হয়। সুতরাং লাইলাতুল কদরে ইতিকাফকারী ঘূমিয়ে থাকলেও তার আমলনামায় ইবাদতের সওয়াব লেখা হলে তিনি লাইলাতুল কদরের পূর্ণ সওয়াব পাবেন।
ইতিকাফ এর শাব্দিক অর্থ হল অবস্থান করা,শরীয়তের পরিভাষায়, যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে নিয়মিত আদায় করা হয়; এমন মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। রমাযানের শেষ দশদিন অর্থাৎ ২০ রমযানের সূর্য অষ্ট যাওয়ার আগ্মুহুর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ উদয় হওয়া পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা সুনাতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোন এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। অন্যথায় সবাই গুনাহগার হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর চিরাচরিয়ত অভ্যাস ছিল রমাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার।
ইতিকাফের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি রমাযানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করবে, সে দুটি হজ ও দুটি উমরাহ পালনের সওয়াব লাভ করবে (বায়হাকি)। তাছাড়া জাহান্নাম ইতিকাফকারী থেকে দূরে থাকে যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে একদিন ইতিকাফ করে , তার আর জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব হয়ে যায়। (বায়হাকী) আর এক খন্দক বলতে বুঝানো হয় অনেক দূরত্ব। যেমন আসমান ও জমিনের মধ্যকার দূরত্ব। এরকম তিন খন্দক পরিমান দূরত্বে জাহান্নাম চলে যায়। সুতরাং বরকতময় এই মাসে আমাদের উচিত পারলে পরিপূর্ণ দশদিন মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে চলে আসা। আর তা সম্ভব না হলে কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলো মসজিদে এসে ইবাদাত কাটানোর চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দিন!
লেখক : খতিব, মসজিদুল আকসা, গোবিন্দপুর, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা