অর্থনীতি বিধ্বংসী কর্মকান্ড জনগণ ক্ষমা করবে না
দুর্নীতিগ্রস্ত ফ্যাসিস্ট সরকারের গণবিরোধী অর্থনীতি বিধ্বংসী কর্মকান্ড জনগণ কখনও ক্ষমা করবে না। একদিন জনতার আদালতে এদের বিচার হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ‘নাই’ হয়ে গেল, তাতে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ বর্তমান ভোটারবিহীন অবৈধ সরকারের জনগণের নিকট কোনও দায়ববদ্ধতা নেই। দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি ব্যাংকিং সেক্টরকে লোপাট করে আরও টাকার পাহাড় গড়তে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অর্থনীতির বারোটা বাজলে তাদের কিছুই আসে যায় না।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ব্যাংকগুলোর মরণ-ঘন্টা: ব্যাংকিং সেক্টর বিপর্যয়ের দায় সরকারকেই নিতে হবে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী সরকারের বর্তমান ক্ষমতার ৯ বছরে দেশের অধিকাংশ সরকারি বেসরকারি ব্যাংক, ননব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিদারুণ ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। সুশাসনের অভাব, জবাবদিহিতার অভাব, দুর্নীতি, লুটপাট, নীতিহীনতা আর বিশৃংখলা সব মিলিয়ে এক অস্থিতিকর ও নৈরাজ্যকর অবস্থায় রয়েছে বর্তমান ব্যাংকিং খাত।
তিনি বলেন, ঋণের নামে ও বিভিন্ন কারসাজি করে গ্রাহকের প্রায় ২ লক্ষ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে আওয়ামী নেতাকর্মী, সমর্থক ও আওয়ামী মদদপুষ্ট গোষ্ঠী। মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর। দেশের একটি স্বনামধন্য গবেষণা সংস্থা তাই ২০১৭ সালে ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে ২০১৭ সালকে ‘ব্যাংক কেলেংকারির বছর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দুই দফায় আওয়ামী লীগ সরকারের ১০ বছর মেয়াদকে ‘ব্যাংক কেলেঙ্কারির দশক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো তীব্র তারল্য সংকটে জর্জরিত উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ধার-দেনা করে চলছে দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক। আমানতকারীরা লাইন ধরে আমানতের টাকা ফেরত নিতে চাচ্ছে। তারা চেক দিয়েও সময়মত টাকা পাচ্ছে না। তহবিলের অভাবে চেক বাউন্স হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনপ্রাপ্ত ঋণও ফেরত নেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকাররা। আশানুরূপ কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত সরিয়ে নিতে চাইছে। একটা আতংক তৈরি হয়েছে। এই আতংক আগে শেয়ার বাজারে ছিল, এখন ব্যাংকে চলে আসছে।’ অথচ অর্থমন্ত্রী পরিস্থিতি গুরুতর নয় বলে দাবি করছেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সাম্প্রতিক আতংকের শুরুটা বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংক কেলেংকারির ঘটনা থেকে শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের ব্যাংক কেলেঙ্কারির শুরুটা হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সোনালী ব্যাংকের ‘হলমার্ক গ্রæপ কেলেঙ্কারি থেকে। হলমার্ক গ্রæপের লোপাটকৃত অর্থের পরিমাণ সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি।
তিনি বলেন, এই অর্থ আত্মসাতের সাথে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের নাম জড়িয়ে আছে। এছাড়াও বিসমিল্লাহ গ্রæপের ১২শ’ কোটি টাকার বহুল আলোচিত ঋণ জালিয়াতির কথা সবাই জানেন। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘সাত বছরে আত্মসাৎ ৩০ হাজার কোটি টাকা’। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারিসহ ছয়টি বড় অর্থ কেলেঙ্কারির বিস্তারিত সবার জানা আছে। তাছাড়া রয়েছে রূপালী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নেওয়া প্রায় হাজার কোটি টাকা, যার ৮০১ কোটি টাকা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া আছে অগ্রণী ব্যাংক থেকে বহুতল ভবন নির্মাণের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ঘটনা। জনতা ব্যাংক সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে একক গ্রাহকের মালিকানাধীন এনটেক্স গ্রুপের ২২ প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছেন যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেংকারি। ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ ব্যাতিত কোন একক ব্যক্তির পক্ষে এত বিশাল ঋণ পাওয়া সম্ভব নয়। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে। দেওয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। রাজনৈতিক বিবেচনায় শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়ার পর ব্যাংকটি দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে চলে যায়। ব্যাংকটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে সংকটে পড়ে। এনআরবি ও এনআরবি গেøাবাল ব্যাংকেও সীমাহীন অনিয়ম হচ্ছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৩ সালে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় ফারমার্স ব্যাংক চালু হবার পর ব্যাংকটি আমানতকারীদের ও সরকারি খাত হতে জমাকৃত অর্থ অধিকাংশ আত্মসাৎ করেছে। ‘নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়ম, জালিয়াতি ও লুটপাটে অতীতের যে কোনো ব্যাংক কেলেঙ্কারি-অনিয়মকে ছাড়িয়ে গেছে।’ বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।’ এই ব্যাংকের কাছে পাওনা যে কেবল ব্যক্তিগত আমানতকারীদের বা প্রতিষ্ঠানের তা নয়, এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৯৯ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সুদসহ যা ৫১০ কোটিতে পৌঁছেছে’। তার মানে, এই অর্থের মালিক এদেশের সাধারণ জনগণ এবং ব্যাংকটি জনগণের এই টাকাও আত্মসাৎ করে বসে আছে।অথচ এই ব্যাংকটি বাঁচানোর জন্য সরকার স¤প্রতি জনগণের করের টাকায় প্রায় ১,১০০ কোটি টাকা মূলধন পুনঃভরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানা যায় যা হবে স¤পূর্ণ অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য।
মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, এ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮০০ কোটি টাকা লুট হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ডলার চুরির ঘটনায় ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা’ রয়েছে এবং ‘ব্যাংক ডাকাতির হোতারা ব্যাংকের ভিতরেই আছে’ বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। বাংলাদেশ সরকারের আশীর্বাদ না থাকলে ব্যাংক ডাকাতির হোতাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে থাকা সম্ভব নয়। চুরি হয়ে যাওয়া অর্থের সামান্য অংশ ফেরত এলেও সিংহভাগ অর্থই আর ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা নেই। চুরির ঘটনার পরপর আমরা ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় সরকারি কর্মতৎপরতা দেখলাম, অথচ বাংলাদেশের বর্তমান অবৈধ সরকার একেবারেই নির্লিপ্ত। এ টাকা উদ্ধারে দীর্ঘ দু’বছর বিলম্বে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল কেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ লুটের বিষয়ে ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টটি কেন আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হলো না তা এখন আর রহস্যাবৃত নয়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে জুন ২০১৭ শেষে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে মন্দ-ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা এর সাথে অবলোপিত ৪৫ হাজার কোটি টাকা, বিভিন্ন অপকৌশলে (ভূয়া দলিল, ভূয়া কোম্পানি, ভূয়া এলসি ইত্যাদি) ৬৫ হাজার কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কোষাগার থেকে ৮শত কোটি টাকা; অর্থাৎ লুটতরাজ আর অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়ে গেছে। অনেকের মতে, ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে বলে যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তা সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এই অর্থের পরিমাণ দেড় থেকে দুই লাখ কোটি টাকার কম নয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, খেলাপি ঋণই বাংলাদেশের ব্যাংক সংকটের মূল কারণ। ঋণের নামে গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত লুটে নিচ্ছে খেলাপিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নরের মতে, ‘খেলাপির সাগরে ভাসছে ব্যাংকিং খাত’। ‘অবলোপন’-এর দোহাই দিয়ে ঋণের তালিকা থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে খেলাপিদের নাম। খেলাপি ঋণসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা বা মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। অর্থাৎ বাড়ার হার ৬.০১ শতাংশে। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা (জুন, ২০১৭ পর্যন্ত)। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, অবলোপন করা ঋণের পরিমাণও ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বেশি। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এর নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত থাকার কথা ৮৫%। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লংঘন করে বেপরোয়া ব্যাংকিংয়ের ফলে ১০ ব্যাংকের আমানত অনুপাতের সীমা ৮৫ ভাগেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। । এতে গোটা ব্যাংক খাতে হঠাৎ করেই বেড়েছে তারল্য চাহিদা। বাড়তে শুরু করেছে ঋণের সুদের হার। আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় অনেকটা ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়ছেন গ্রাহকেরা। কিছু ব্যাংকের বেপরোয়া ঋণদানের কারণে কলমানিতের সুদের হারও বেড়ে গেছে। সুদ হার কমায় দুই বছর ধরেই আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এ সত্তে¡ও কয়েকটি ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে।