শিকলে বন্দি বৃষ্টির ১০ বছর!
চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি : গলায় শিকল, পায়ে শিকল; সঙ্গে দুটি তালা! ভাঙাচোরা ঘরের বাঁশের খুঁটির সঙ্গে পশুর মতো বাঁধা! এভাবেই জীবনের ১০টি বছর কেটে গেছে মানসিক প্রতিবন্ধী শুকজান নেছা বৃষ্টির (১৫)।
জন্মের পর মারা যান বৃষ্টির মা রোজিনা খাতুন। বাবা মনিরুল ইসলাম আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। কোনো জায়গায় ঠাঁই হয় না বৃষ্টির। অবশেষে শতবর্ষী বুড়া মা (মায়ের দাদি) রাহেলা বেগমের কাছে আশ্রয় মেলে তার। পাবনার চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া ইউনিয়নের ধানকুনিয়া সরকারপাড়া গ্রামে জীর্ণ-শীর্ণ ঘরে দিনরাত শিকলবন্দি হয়ে থাকতে হয় বৃষ্টিকে!
সরেজমিনে শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, ঝুপড়ি একটি ঘরে বুড়া মার সঙ্গে বসে আছে বৃষ্টি। পরনে ছেঁড়া কাপড়। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। শিকলের ভারে ঘাড় শক্ত হয়ে গেছে। তবুও নেই কোনো অনুভূতি।
এই প্রতিবেদককে দেখে বৃষ্টি বলে ওঠে, ‘পাবনা যাব, ডাক্তার দেখাব।’
কিছু সময় পর আবারও বলে ওঠে, ‘মাথা শট, মাদ্রাজ যাব, চিকিৎসা করাব। ব্রেনের চিকিৎসা করাব।’
এ সময় চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বসতে বলে সে। বছর চারেক আগে ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আল মামুন বৃষ্টিকে প্রতিবন্ধী ভাতা এবং রাহেলা বেগমকে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছিলেন। সেই ভাতার টাকা দিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটে বৃষ্টি ও রাহেলা বেগমের।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ বুড়া মা রাহেলা বেগম টাকার অভাবে বৃষ্টির চিকিৎসা করাতে পারেননি। এদিকে রাহেলা বেগমের ছেলেদের এ ব্যাপারে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাতার টাকা তাদের কাছে দিলে মেলে খাবার, নয়তো না খেয়েই থাকতে হয়। তবে চিকিৎসা করালে বৃষ্টি ভালো হতে পারে বলে ধারণা প্রতিবেশীদের।
রাহেলা বেগম যুগান্তরকে জানান, পাঁচ বছর বয়স থেকে তার (বৃষ্টি) পাগলাটে ভাব শুরু হয়। মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত। তাকে কেন্দ্র করে পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকত। অন্যের বাড়ির জিনিসপত্র নষ্ট করা শুরু করে। এছাড়া মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেত। কোনো উপায় না পেয়ে ভয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে বৃষ্টিকে।
রাহেলা বেগম বলেন, ‘মাঝেমধ্যে বৃষ্টি মায়ের কাছে যাব বলে আবদার করে। কিন্তু ওর মা তো পৃথিবীতে নেই! আমি মরে গেলে ওকে দেখবে কে?’
ধানকুনিয়া গ্রামের শিক্ষক এসএম ফিরোজুর রহমান বলেন, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি অমানবিক দেখালেও একজন বৃদ্ধ মানুষের পক্ষে মানসিক প্রতিবন্ধী বৃষ্টিকে আটকে রাখা অসম্ভব। চিকিৎসা করালে মেয়েটি হয়তো ভালো হতে পারে। কিন্তু তাদের সামর্থ্য নেই। রাহেলা বেগমের ছেলেরা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত। বৃষ্টি ও রাহেলা বেগমের জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকার অসীম কুমার বলেন, ‘১০ বছর ধরে মেয়েটি শিকলে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে, এটা খুবই দুঃখজনক। আমি খোঁজ নিয়ে অবশ্যই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং পরিবারটির পাশে দাঁড়াব।’ যুগান্তর