ড্যাস বিমান মানেই আতঙ্ক
কানাডায় প্রস্তুতকৃত ‘ডি হ্যাভিল্যান্ড কানাডা ড্যাস (ডিএইচসি)’ মডেলের বিমান যাত্রা করে ১৯৮৪ সালে। তবে চার বছরের মাথায় উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটিতে আগুন ধরে যায় একটি বিমানে। হরিজন এয়ার পরিচালিত ওই ফ্লাইটটি (২৬৫৮) জরুরি অবতরণে সফল হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান যাত্রীরা। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র তিন দিনের মাথায় ইউরোপ ইউনিয়নভুক্ত দেশ ডেনমার্ক ও লুথিনিয়ায় স্ক্যানডিনাভিয়ান এয়ারলাইন্সের (এসএএস) দুটি বিমানও দুর্ঘটনায় পড়ে। গত ৩০ বছরে অন্তত এমন ১০টি বড় ধরনের দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ড্যাস-৮ মডেলের এসব বিমান। তাই উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো যখন অভ্যন্তরীণ রুট ও কম দূরত্বে চলাচলে সক্ষম এ বিমানগুলো গুটিয়ে নিচ্ছিল তখন আন্তর্জাতিক রুটে পরিচালনার দুঃসাহস দেখায় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইউএস বাংলা এয়ার।
তাও আবার রিকন্ডিশনে কিনে আনা ১৭ বছরের পুরনো বিমান দিয়ে।সংশ্লিষ্টরা বলছে, বেসরকারি বিমানের ফ্লাইট পরিচালনায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘সিভিল এভিয়েশন অব বাংলাদেশের (সিএবি) বাস্তবিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বিমান নিয়ে দূরাকাশ পাড়ি দিয়ে আসছিল ইউএস বাংলা। এ কারণেই ৭১ আরোহী নিয়ে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগে আগুন ধরে দুর্ঘটনায় পড়ে ইউএস বাংলার ড্যাস-৮ কিউ ৪০০। এর আগেও উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ১১ বার রানওয়েতে দ্রুত অবতরণ করে ৬৫ থেকে ৭০ যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এ বিমানটি। সামান্য ঝড়ো বাতাসের কারণে আকাশপথে চলাচলের অনুপযোগী এসব বিমান দিয়েই আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে ইউএস বাংলা। এমনকি পুরনো বোয়িং দিয়ে সম্প্রতি সুদূর চীনেও বিমান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ইউএস বাংলা এয়ারের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ আসে। গত বছরের ৭ এপ্রিল ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে পরিচালিত একটি ফ্লাইটে যাত্রীদের পচা-দুর্গন্ধযুক্ত খাবার সরবরাহের অভিযোগে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভ্রাম্যমাণ আদালত।এদিকে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের ১৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের শিয়াটল তাকোমা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর আগুন ধরে প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনার শিকার হয় ড্যাস-৮ বিমান। ১৯৯০ সালের ২১ নভেম্বর থাইল্যান্ডে দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপাঞ্চল ‘কো সামুই’ এলাকায় অবতরণের সময় ঝড়বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত হয় ব্যাংক এয়ারওয়েজ পরিচালিত ড্যাস-৬।
এতে ৩৮ যাত্রী ও বিমান ক্রু প্রাণ হারান। ১৯৯৩ সালের ৬ জানুয়ারি ফ্রান্সের ‘প্যারিস চার্লস ডি গল এয়ারপোর্ট’ রানওয়ের কাছে ‘লুফথানসা সিটিলাইন‘ পরিচালিত ৫৬৩৪ ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ২৩ যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে ৪ জন। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে দেশটির পালমারস্টন নর্থ বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ১৯৯৫ সালের ৯ জুন ল্যান্ডিং রানওয়ের ১৬ কিলোমিটার কাছে এসে দুর্ঘটনায় ৪ জন মারা যান।২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির নিউইয়র্ক লিবার্টি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে কানাডা সীমান্তবর্তী বাফেলো নায়াগ্রা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে নিউইয়র্কের ক্লিয়ারেন্স সেন্টারের (স্থানীয় পরিসংখ্যান দপ্তর) ওপর বিধ্বস্ত হয় একটি বিমান।
এতে এক বিমানযাত্রী নিহত ও দপ্তরে থাকা দুজন আহত হন। ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘ইউনাইটেড স্টেটস আফ্রিকা কমান্ড’ পরিচালিত মালিতে জরুরি অবতরণের সময় ২৯ সেকেন্ডের মধ্যে একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ‘এয়ারলাইন্স ডিএনজি’ পরিচালিত ড্যাস-৮ বিমান পাপুয়া নিউগিনিতে দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ৩২ আরোহীর ২৮ জনই প্রাণ হারান। ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল এয়ার তানজানিয়া পরিচালিত বিমান উড্ডয়নের সময় বোর্ডসহ ৩৯ জনের সবাই নিহত হন।
২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর লুক্সেমবাগের ‘লাক্সএয়ার’ পরিচালিত বিমানটি জার্মানির ‘সারব্রাকেন বিমানবন্দর’ থেকে উড্ডয়নের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ২০ জন আহত হন। সর্বশেষ নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে এ দুর্ঘটনা। পর্বতে ঘেরা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরটিতে প্রায়ই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও গতকাল বিমানটির বিধ্বস্ত হওয়ার প্রাথমিক কারণ জানা যায়নি।এ ছাড়া ছোট ধরনের দুর্ঘটনায়ও ড্যাস বিমান এগিয়ে। ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্ক্যানডিনাভিয়ান এয়ারলাইনসের (এসএএস) একটি ফ্লাইট ডেনমার্কের কোপেনহেগেন থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ নেদারল্যান্ডসের অ্যালবর্গ যাওয়ার পথে যান্ত্রিক কারণে জরুরি অবতরণ করে।
এতে ১১ জন আহত হন। তিন দিন পর স্ক্যানডিনাভিয়ান এয়ারলাইনসের আরেকপি ড্যাস-৮ একই ধরনের সমস্যায় পড়ে লুথিনিয়ার ভিলিনিয়াস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পাশাপাশি নরওয়ে একটি, ডেনমার্কে চারটি, জার্মানিতে একটি, জাপানে একটি, লুথিনিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ড্যাস বিমান দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।