‘আমাদের দেশে কমার্শিয়াল ছবির ধারণাটা পাল্টাতে হবে’
বিনোদন প্রতিবেদক : দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া। ২০১৭ তার জন্য পুরস্কার, সম্মাননা আর সাফল্যের বছর ছিল। দেশের চেয়ে কলকাতার চলচ্চিত্রেই জয়া যেন নিজের সামর্থের প্রমাণ দিতে পেরেছেন বেশি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে জয়া বললেন দেশীয় চলচ্চিত্রে তার সংকটের কথা
প্রশ্ন : নতুন বছরের শুরুতেই আপনার দু’টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সাইফুল ইসলাম মান্নু পরিচালিত ‘পুত্র’ অন্যদিকে কলকাতায় মনোজ মিচিগানের পরিচালনায় ‘আমি জয় চ্যটার্জি’। কীরকম লাগছে?
জয়া : এটা খুবই খুশির খবর যে, ‘পুত্র’ ছবিটি রিলিজ হচ্ছে। এটা স্পেশাল চাইল্ডদের কে নিয়ে করা। বাংলাদেশ সরকারের এখানে একটা হস্তক্ষেপ আছে। ছবিটা আমি একটা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমি করেছি।
আমি মনে করি ‘পুত্র’একটা মিডল ছবি, একটা মানবিক ছবি। একটা দায়িত্বের জায়গা থেকে তৈরি করা ছবি, এবং খুবই সমসাময়িক একটা সমস্যা থেকে তৈরি করা ছবি। আমার মনে হয়, দর্শকেরও সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে ছবিটা দেখা উচিত।
আর ‘আমি জয় চ্যাটার্জি’ ছবিটা নিয়ে বলছি- সেটাও একটা অন্যরকম অ্যাপ্রোচের ছবি। সোল জার্নি, সোল ট্রান্সফরমেশনের একটা গল্প। খুব ভালো একটা গল্প। বাংলাদেশের দর্শক হয়তো পরে দেখতে পারবেন ছবিটা।
প্রশ্ন : কলকাতায় আপনার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো বাংলাদেশের দর্শক যথাসময়ে দেখতে পান না, দর্শকের সঙ্গে আপনার দূরত্ব তৈরি হচ্ছে?
জয়া: আমার একটা কষ্টের জায়গা এটা। আমি যেহেতু যৌথপ্রযোজনার ছবিতে কাজ করি না, কাজ করিনি এবং এখনও করিনি, সেজন্য আমার অনেক ভালো ভালো ছবিই বাংলাদেশের দর্শক দেখতে পারেন না।
সেটার জন্য আমি নিজেও বঞ্চিত করছি আমার দর্শকদের। এ কারণে আমার নিজেরও মন খারাপ থাকে।
প্রশ্ন : নতুন বছরে আপনার কী কী ছবি পাচ্ছে দর্শক?
জয়া: আমার এখানে ‘বিউটি সার্কাস’ টা বাকি আছে। ওটা এ ফেব্রুয়ারিতেই শেষ হবে যতদূর জানি। ছবিটা আসা উচিত বলে মনে করি।
কলকাতার ছবিগুলো তো খুব তাড়াতাড়ি রিলিজ দিয়ে দেয়। সেখানে আমার বাকি আছে জীবনানন্দ দাশের উপর যে ছবিটা-‘পলাতক’; সৃজিতের ‘এক যে ছিল রাজা’ ছবিটার শুটিং শুরু হবে সামনে, সেটা আসবে। ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ বলে একটা ছবি আসবে।
সবমিলে ওখানে তিন-চারটা ছবি আছে যেগুলো মুক্তি পাবে। জানুয়ারিতে একটা ছবি মুক্তি পাচ্ছেই। আর ওখানে বেশ কিছু ছবির ব্যাপারে আলাপ চলছে, যেগুলো এখনই বলতে চাই না।
বলতে চাইনা এ অর্থে যে ছবির সাইনিং বা শুটিং শুরু না হলে বলবার মতো কিছু নেই।
এছাড়া আরও কিছু ভালো ছবি বড় ডিরেক্টরদের সাথে করবার কথা আছে। আমার নিজের ছবি ‘দেবী’র কাজ শেষ হয়ে আছে। সম্পাদনার কাজ শেষ করে অবশ্যই এ বছর ছবিটা রিলিজ দিবো।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের চাইতে কলকাতায় আপনার ছবি বাড়ছে, প্রশংসিতও হচ্ছেন। কিন্তু দেশে আপনার সংকটটা আসলে কোথায়?
জয়া: ওরা চাইছে বলে বাড়ছে। এখানে হয়তো ওভাবে চাইছে না বলে বাড়ছে না। কারণ বাংলাদেশে তো আমি অনেকদিন ধরেই বেশকিছু ছবি করছি, দেখুন ‘পুত্র’ ছবিটিই ২০১৫ সালে করা। এটা রিলিজ হচ্ছে ২০১৮ তে।
‘বিউটি সার্কাস’ ছবিটা আটকে আছে। নুরুল আলম আতিকের ‘পেয়ারার সুবাস’ ও ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ আটকে আছে। এগুলো তো আসলে আটকে আছে।
আমার কাজ অভিনয় করা, ওটা করার পর আমার তো আসলে কিছু করার থাকে না।
গতবছর অনেকগুলো কাজ করেছি। এতগুলো কাজ করলে আসলে কোয়ালিটিও থাকে না। বাংলাদেশের ছবিগুলোতেও শিডিউল দিয়েছি। কিন্তু নানা জটিলতায় ছবিগুলোর কাজ শেষ হয়নি।
যেমন, আমি ‘খাঁচা’ ছবিটা করেছিলাম, রিলিজ হয়ে গেল, ভালো লাগলো। একটা ছবি যদি মুক্তি পায়, আলোর মুখ দেখতে পায় সেটা আসলে ডিরেক্টরের জন্যও ভালো, আমার জন্যও।
আমি অবশ্যই চাই যে, বাংলাদেশের ছবি বেশি করতে, সেটা আসলে করা হয়ে উঠছে না।
প্রশ্ন : সেক্ষেত্রে বড়পর্দায় নতুন বছরে আপনার কৌশলটা কেমন হবে?
জয়া: আমার সবসময়ই ন্যুনতম একটা মার্জিন থাকে, যে এই ছবিটা করতে পারবো, এই ছবিটা করতে পারবো না। শিল্পমান থাকতে হবে, কাজটার মান থাকতে হবে, এবং ডিরেক্টরের ওপর ভরসা করতে হবে।
সেরকম কাজ আমি গতবছর বেশকিছু করেছি। যথেষ্ট ফোকাস ছিলাম বাংলাদেশে। কিন্তু এখানে সমস্যা হয় কি, ছবিগুলোর পূর্ণরূপ দেখতে অনেক দেরী হয়ে যায়।
ওখানকার ছবিগুলো দু’তিন মাসে রেডি করে ফেলে এবং মুক্তি দিয়ে দেয়। এটা তো আমাদের দুর্ভাগ্য, আমার তো আর কিছু করবার নেই।
যে ছবিগুলো করতে চাই, যে ছবিগুলো আমি বিশ্বাস করি, মানসম্পন্ন যেসব ছবি করতে চাই সেগুলো যদি এখানেও হয়, সেগুলো আমি করছিই আসলে।
বাংলাদেশেও আমি শিডিউল দিচ্ছি ধীরে ধীরে। ‘খাঁচা’ টা মুক্তি পেল। বাকিটাও মুক্তি পাবে ইনশাল্লাহ।
তারপরও অনেকগুলো ঝুলে আছে, সেগুলো আমার কারণে না। বারবার শিডিউল নেয়ার পরও আমি করতে পারছি না নানা জটিলতার জন্য।
আর কলকাতাতেও আমি খুব বেশি ছবি করতে চাই না। ওখানেও দু’দিন পরপরই আমার কাছে স্ক্রিপ্ট আসে। সবধরণের স্ক্রিপ্ট আসে। সব আমি করছি না। কলকাতাতেও আমি কাজ কমিয়ে দিয়েছি, অল্প কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন : কমার্শিয়াল ছবির দিকে ঝুঁকেছিলেন। সেদিকে কি আগ্রহটা এখনও আছে?
জয়া: ঝুঁকিনি আসলে, আমি করেছি। কমার্শিয়াল ছবিতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কমার্শিয়াল ছবি মানে যদি হয় নানা রকম রংবেরঙের জামাকাপড় পড়ে সাগরপাড়ে নাচানাচি সেটা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।
যেমন, ‘বিসর্জন’ একটা পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল ছবি। ওটা কিন্তু সাকসেসফুল ছবি।
আমাদের দেশে কমার্শিয়াল ছবির ধারণাটা পাল্টাতে হবে। আমাদের দেশে আমরা যেসব ছবিকে কমার্শিয়াল ছবি বলি, কলকাতার বাজারে ওগুলো এখন আর কেউ দেখছে না।
কলকাতার বাজারে এখন কমার্শিয়াল ছবিগুলো হচ্ছে সৃজিত মুখার্জীর ছবি, অরিন্দম শীলের ছবি ‘ঈগলের চোখ’, ‘বিসর্জন’ এগুলো এখন কমার্শিয়াল ছবি।
আমিও আসলে চাই যে, এই যে মিডল ছবিগুলো অনেক বেশি বেশি করে বাংলাদেশে হওয়া দরকার। যেগুলো আমাদের মধ্যবিত্ত দর্শকরা দেখতে পারবে।
দর্শকের রুচির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দর্শকের রুচির পরিবর্তনের জন্য আমাদেরও একটা আদর্শিক জায়গা থাকা দরকার। যে দায়িত্বটা আমাদের, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের…। সে জায়গা থেকে কমার্শিয়াল ছবি হোক যেটাই হোক আমার কিন্তু করতে কোনোই আপত্তি নেই।
প্রশ্ন : নতুন বছরে দর্শকদের কাছে কী চাইবেন?
জয়া: ভালো ছবি শুধু হলেই হয় না। এটা ডিস্ট্রিবিউটর থেকে শুরু করে প্রডিউসার এমনকি আমাদের দর্শক তাদেরও দায়িত্ব আছে ছবিটা সবার কাছে পৌঁছে দেয়ার।
বাংলাদেশে একটা সমস্যায় আমি প্রায়ই ভুগী। আচ্ছা এ ছবিটা ল্যাপটপে কবে দেখা যাবে? এটা আমরা ইন্টারনেটে কবে দেখতে পাবো? ইউটিউবে কবে দেখতে পাবো? অনেক সেন্সিবল দর্শককেও আমি এ কথা বলতে শুনি।
এটা কিন্তু একধরণের চুরি। চুরি করার সাথে এ কাজের কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু এটা যে চুরি করা সেটা অনেকে বুঝতেই পারে না। এটা দর্শকদের জন্য হল উপযোগী করেই তৈরি করা হয়। এটা বড়পর্দার জন্য এবং দর্শক যেন হলে যায়।
ছবি আমরা বানালাম সবাই মিলে, আপনি দর্শকদের কাছে খবরটা পৌঁছে দিলেন, কিন্তু সেই দর্শক যদি পার্টিসিপেট না করে তাহলে সে ছবিটা ছবি হবে না।
তাই আমি দর্শকদের বলবো, জ্যাম ঠেলে, কাজ ফেলে হলে গিয়ে ছবিটা দেখুন । আমরাওতো কষ্ট করে ছবিটা করি।
দু’জায়গার দর্শকদের প্রতিই আমার শুভকামনা। তারা যেন আমাদের ছবিগুলোর পাশে থাকে।