চাপে আছে মিয়ানমার, ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ
---
রাখাইনে গণহত্যা, জাতিগত নিধন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ অন্যান্য নির্যাতনের কারণে এ বছরের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে মিয়ানমারের ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এই মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে সারাবিশ্ব। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই কর্মকাণ্ডকে বলেছে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যবই উদাহরণ’। নিরাপত্তা পরিষদে শুধু মিয়ানমার নিয়েই আলোচনা ও বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতি নিয়ে ভোটাভুটিতে ১৩৫টি দেশ ভোট দিয়েছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমার থেকে ফিরে উল্লেখ করেন, রাখাইনে যে জাতিগত নিধন চলছে তা পরিষ্কার। এককথায় বলা যায়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে মিয়ানমার।
এর বিপরীতে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সারাবিশ্ব বাংলাদেশের প্রশংসা করছে ও সমর্থন দিচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারকে সমর্থন দেওয়া চীন, রাশিয়া আর ভারতও বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক সহায়তা দেখিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে থাকা মিয়ানমারের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে দর কষাকষিতে ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একাধিক বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এগুলো হলো— সব রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন, জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা, স্বচ্ছ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া, নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন ও তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি। কিন্তু সমঝোতা স্মারকে যে এসবের বেশিরভাগই নেই তা ধারণা করা হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের ছাড় দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
৪৮ ঘণ্টার সাসপেন্স
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে দুই দেশ বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে সমঝোতা করেছে মিয়ানমারে। শনিবার (২৫ নভেম্বর) ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলি বিস্তারিত তুলে ধরবেন বলে জানানো হয় তার মন্ত্রণালয় থেকে। ফলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যুতে কী চুক্তি হয়েছে এবং এখানে বিস্তারিত বিষয়বস্তু কী, তা জানার জন্য ৪৮ ঘণ্টার সাসপেন্সে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, খুশির খবর থাকলে সাধারণত এত দেরি করে দেওয়া হয় না।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সমঝোতা (অ্যারেঞ্জমেন্ট) স্বাক্ষর করেছে। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে দুই মাসের মধ্যে।
এছাড়া তিন সপ্তাহের মধ্যে গঠন করা হবে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। একইসঙ্গে শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার পথ তৈরির জন্য দ্রুততার সঙ্গে স্বাক্ষর করা হবে একটি নির্দিষ্ট দ্বিপক্ষীয় চুক্তি (ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট)।
এমনিতে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার কারণে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে মিয়ানমার। তবে শরণার্থীদের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পথ তৈরিতে তড়িঘড়ি দর কষাকষিতে বাংলাদেশ ছাড় দিচ্ছে বলে মন্তব্য কূটনীতিকদের।
মতবিরোধের বিষয়
বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একাধিক বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এগুলো হলো— সব রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন, জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা, স্বচ্ছ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া, নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন ও তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা ইত্যাদি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। কিন্তু ‘সব’ রোহিঙ্গা ফিরে যাবে কিনা তা নির্দিষ্ট করে জানানো হয়নি। আবার সময়ের বিষয়ে বলা আছে, দুই মাসের মধ্যে শুরু হবে। কিন্তু এর শেষ কবে তা উল্লেখ নেই।
মতবিরোধের বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ কতটুকু অর্জন করতে পারলো আর কতটুকু ছাড় দিলো সেই সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুখ বন্ধ রেখেছে। ৪৮ ঘণ্টার সাসপেন্স শেষে এসবের উত্তর মিলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলির বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়নি! বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে সমঝোতা স্বাক্ষরের পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন তিনি। ঢাকার একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদে প্রচারিত তার ভাষ্য ছিল এমন— ‘এটি প্রথম পদক্ষেপ। এবার দুই দেশকে পরের ধাপে যেতে হবে। এখন কাজটা শুরু করতে হবে। সমঝোতা স্মারকে সব বিবরণ আছে।’
তিন মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া শুরু হবে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই টিভি চ্যানেলকে বলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে ফেরতের বিষয়টি মুখ্য নয়, এখন এই কাজটা শুরু করতে হবে। রাখাইনে বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই বাড়িঘর তো তৈরি করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞদের মতামত
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দলে দলে প্রথমবার পালিয়ে আসে ১৯৭৮ সালে। তখন তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তিস্বাক্ষর হয়। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারে বাংলাদেশের প্রাক্তন ডিফেন্স অ্যাটাশে শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৭৮ সালের চুক্তিতে বলা ছিল— ছয় মাসের মধ্যে সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হবে। পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ২ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে গিয়েছিল।’
১৯৯২ সালে আবারও দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ওই সময় তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আরেকটি সমঝোতা হয়। তবে এতে সময়সীমা নির্দিষ্ট করা ছিল না। এ কারণে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩ বছরে ২ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে গেছে।
প্রাক্তন ডিফেন্স অ্যাটাশে বলেন, ‘এখনকার চুক্তিতে সময় নির্দিষ্ট করা না থাকলেও ১৯৯২ সালের গতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে কতদিন লাগবে তা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শহীদুল হক বলেন, ‘২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময় প্রত্যাবাসনের জন্য ৬ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।’
রোহিঙ্গাদের যদি মংদুতে কোনও ক্যাম্পে রাখা হয় তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে ইসরায়েলের গাজার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রাক্তন ডিফেন্স অ্যাটাশে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া শুরু হবে। আবার টিভিতে দেখা গেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারে সাংবাদিকদের বলেছেন ভিন্ন কথা। ঠিক বুঝতে পারছি না কোনটা ঠিক।’
প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘১৯৯২ সালের সমঝোতা এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে বর্তমানে নতুন একটি ফর্মুলা প্রয়োজন।’
প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো জরুরি, যেন তারা রাখাইনে ফিরে যেতে উৎসাহিত হয়।’
এই পেশাদার কূটনীতিকের মন্তব্য— শুধু ফিরে গেলেই হবে না, তাদের নিরাপত্তা ও মিয়ানমারে সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।