পাইকারি পর্যায়েও দাম বেড়েছে বিদ্যুতের
---
অর্থনীতি ডেস্ক : ভোক্তা পর্যায়ের পাশাপাশি বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানি পর্যায়েও বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে। যদিও বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়ানো হলেও পাইকারি দাম বাড়েনি বলে গত বুধবার ঘোষনা দিয়েছিল এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসির জারিকৃত বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষনেই এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে সব শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মতামত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা।
তারা বলছেন, গত আট বছরে বিদ্যুতের দাম আট বার বাড়লেও নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুত্ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হলেও সরকার বেশি দামে উৎপাদনের সুযোগগুলো গ্রহণ করছে। এরপর ঘনঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মতই বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। নিম্নআয় এবং মধ্যবিত্তের খরচ বাড়বে। শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে দামবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। ক্ষুদ্রশিল্প, বাণিজ্যিক ও শিল্প বিদ্যুতের দাম বাড়ায় পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়বে। ফলে একদিকে বাণিজ্যিক খরচ বাড়বে অন্যদিকে বিভিন্ন ধরণের পণ্যের দামবৃদ্ধিও ঘটবে।
প্রতিক্রিয়া:দামবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যমান বাস্তবতায়ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নয়, কমানো যায়। বিইআরসির শুনানিতে আমরা সেটি হিসেব কষে প্রমাণও করেছি। এরপরও দামবৃদ্ধি শুধু অযৌক্তিকই নয় বরং স্বেচ্ছাচারিতাও। তিনি বলেন, দাম বৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে সরকার এবং বিইআরসি বরাবরের মত বলছে- সবকিছুরই দাম বাড়ে তেমনি বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। এটি যৌক্তিক নয়। তাহলে গণশুনানি কেন? এখন প্রমাণিত হলো- গণশুনানি অকার্যকর এবং অর্থহীন। এটি লোকদেখানো প্রহসন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই তড়িত্ প্রকৌশলী বলেন, সরকার কমদক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবির বিদ্যুেকন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপানো হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুতের গড় খুচরামূল্য ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিইআরসি। বিদ্যমান গড় দাম ৬ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৬ টাকা ৮৫ পয়সা কার্যকর হবে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে। গ্রাহকশ্রেণি এবং ধাপভেদে এ দাম সাড়ে ৩ টাকা থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, বিদ্যুতের যে দাম বাড়ানো হয়েছে, আমি মনে করি এটি খুবই সামান্য এবং মামুলি ব্যাপার। জনজীবনে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করি না। দাম বৃদ্ধির কাজটি বিইআরসি নিজস্ব বিবেচনা থেকে বাড়িয়েছে, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো প্রভাব নেই। সমালোচক বা নিন্দুকরা এ নিয়ে সমালোচনা করলেও দামবৃদ্ধি অযৌক্তিক নয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও সরকারকে এখনও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া লাগবে।
তিনি বলেন, গ্রামে-গঞ্জে লাইফ লাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের বিল বাড়েনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের বিল সামান্য বেড়েছে। মিনিমাম চার্জ একটা নেওয়া হত, সেটাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সামঞ্জস্যকরণ করা হয়েছে। দাম বাড়ানো নিয়ে কেউ কোনো রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক খেলায় মেতে না উঠলে সব ঠিক থাকবে।
একই প্রসঙ্গে বিইআরসির কাছে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি গড়ে ১৫ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল জানিয়ে বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, যেকোনো মূল্য সমন্বয়েরই কমবেশী প্রভাব থাকে। তাহলে যে হারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হয়েছে তা খুব বেশি কিছু নয়। তবুও হয়ত গ্রাহক পর্যায়ে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু সেটি সহনীয় এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে।
কোম্পানিভেদে পাইকারি বিদ্যুতের দাম কমেনি বরং বেড়েছে
বৃহস্পতিবার বিজ্ঞপ্তিতে বিইআরসি বলে, কমিশন বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বিইআরসির আদেশ বিশ্লেষনে দেখা যায়, শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ছাড়া অন্য সব বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানির জন্য পাইকারি মূল্য বাড়ানো হয়েছে।
বিদ্যমান মূল্যহার অনুযায়ী পিডিবির বিতরণ অঞ্চলগুলোতে ২৩০ কেভির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৯৮ পয়সা। নতুন মূল্যহারে এটি বেড়ে দাড়িয়েছে ৫ টাকা ৩৫ পয়সা। ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভির বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম যথাক্রমে ৫ টাকা ৬ পয়সা ও ৫ টাকা ১২ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ টাকা ৪০ ও ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। ডিপিডিসির ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভির বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম যথাক্রমে ৫ টাকা ৬৮ পয়সা ও ৫ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ টাকা ৮৭ পয়সা ও ৫ টাকা ৯২ পয়সা। ডেসকোর ১৩২ কেভি বিদ্যুতের দাম ৫ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে ৪৮ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৬ টাকা ১৬ পয়সা। ৩৩ কেভির দাম ৫ টাকা ৮৫ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা হয়েছে। ওজোপাডিকো’র ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভির বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম যথাক্রমে ৪ টাকা ৫৮ পয়সা ও ৪ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫ টাকা ৭৮ ও ৪ টাকা ৮৩ পয়সা।
তবে পল্লী বিদ্যুতের এবং নেসকোর পাইকারি বিদ্যুতের দাম কমেছে। আরইবির ১৩২ কেভি বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ১৭ পয়সা থেকে ১০ পয়সা কমে হয়েছে ৪ টাকা ৭ পয়সা। ৩৩ কেভির দাম ৪ টাকা ২৩ পয়সা থেকে কমে ৪ টাকা ৫৭ পয়সা হয়েছে। নবগঠিত নেসকোর বিতরন এলাকা আগে পিডিবির অধীনে ছিল। এবারই প্রথম নেসকোর জন্য মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, নেসকোর ১৩২ কেভি এবং ৩৩ কেভির বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দাম যথাক্রমে ৫ টাকা ৬ পয়সা ও ৫ টাকা ১২ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৪ টাকা ৪৪ পয়সা ও ৪ টাকা ৪৯ পয়সা।
এ প্রসঙ্গে বিইআরসির সদস্য (বিদ্যুৎ) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় পাইকারি মূল্য ৪ টাকা ৯০ পয়সা। সেটি নতুন মূল্যহারে ৬ পয়সা কমে হয়েছে ৪ টাকা ৮৪ পয়সা। মূলত: নেসকো পিডিবির চেয়ে কম দাম পাওয়ায় এবং পল্লী বিদ্যুতের দাম কমানোয় পাইকারি বিদ্যুতের গড় দাম কমেছে। তবে অন্যান্যদের পাইকারি দাম বেড়েছে।
অর্থাৎ সব সংস্থা-কোম্পানি মিলিয়ে পাইকারি বিদ্যুতের গড় দাম কমলেও বিতরণকারী কোম্পানি ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো ও পিডিবির জন্য দাম প্রকৃত অর্থে বেড়েছে। এগুলোর অধীনেই সিংহভাগ বিদ্যুত্ ব্যবহারকারী।
গ্রাহকের সরসরি ব্যয় বাড়বে ১৭শ’ কোটি টাকা
বিদ্যুতের খুচার দাম ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়ায় গ্রাহকদের বার্ষিক সরাসরি খরচ বাড়বে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এই অর্থ বিতরণকারী কোম্পানি-সংস্থাগুলোর কোষাগারে যাবে জনগণের পকেট থেকে। বিদ্যুৎনির্ভর পণ্য উৎপাদন খরচবৃদ্ধি এর বাইরে রয়েছে।
বিইআরসির ঘোষনায় বলা হয়, ২০১৮ সালে পিডিবি প্রায় ৬ হাজার ১০০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে। এর মধ্যে সঞ্চালন লস দুই দশমিক ৭০ শতাংশ বা প্রায় ১৬০ কোটি ইউনিট। ফলে পাইকারি হিসাবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে ৫হাজার ৯৪০ কোটি ইউনিট বিদ্যুত্ বিক্রি করবে পিডিবি। এদিকে গড় বিতরণ লস ধরা হয়েছে ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ বা ৫৭০ কোটি ইউনিট। ফলে ৫ হাজার ৩৭০ ইউনিট বিদ্যুত্ গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি করা হবে। এ বিদ্যুতের উত্পাদন ব্যয় চার টাকা ৭৯ পয়সা। আর হুইলিং চার্জ ২৬ পয়সা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫ টাকা ৫ পয়সা। এর সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ লোকসান যোগ করে ব্যয় দাঁড়াবে ৫ টাকা ৬১ পয়সা। এর সঙ্গে বিতরণ কোম্পানিগুলোর গড় ব্যয় এক টাকা ২৪ পয়সা যোগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুতের গড় বিক্রয়মূল্য ব্যয় দাঁড়াবে ৬ টাকা ৮৫ পয়সা। বর্তমানে বিদ্যুতের গড় মূল্য ৬ টাকা ৫০ পয়সা। ফলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে গ্রাহকদের সরাসরি ব্যয় বাড়বে বছরে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
শিল্প উৎদন খরচ বাড়বে, পড়বে নেতিবাচক প্রভাব
বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে শিল্প ও বাণিজ্যখাতে। কিছুদিন পর পর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অনিশ্চয়তা তৈরি করে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করেন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে শিল্পের উত্পাদন খরচ আরেক দফা বাড়বে। এর প্রভাব রপ্তানি শিল্প এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়েও পড়বে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এভাবে দাম না বাড়িয়ে সরকার পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা দিয়ে রাখলে ভালো হয়। এর বাইরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর বৃদ্ধি বা কমার সাথে দর সমন্বয় হবে। এ রকম পরিকল্পনা থাকলে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। ফের বিদ্যুতের দর বাড়ায় উত্পাদন ব্যয় আরেক দফা বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজারের উত্পাদকের পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতায় সক্ষমতার ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে তাও শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে। নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসায়ীদের জন্য দামবৃদ্ধি বড় সমস্যা হবে না। কিন্তু সেটি এখনই নিশ্চিত না হওয়ায় শিল্পে-বাণিজ্যে খরচ বাড়বে।