মঙ্গলবার, ২৮শে নভেম্বর, ২০১৭ ইং ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

মাদক নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে

AmaderBrahmanbaria.COM
নভেম্বর ২৫, ২০১৭
news-image

---

ডেস্ক রিপোর্ট : দেশজুড়ে মাদকের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। দেশের ৩২ জেলার সীমান্তবর্তী ৫১ য়েন্ট দিয়ে পাচার করে আনা হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য।

এ ছাড়া স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথেও দেশে ডুকছে হরেক নামের মাদক। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সহজেই তা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। অনেক এলাকায় খুচরা বিক্রেতারা দিচ্ছেন ‘হোম সার্ভিস’। ফোন করলেই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মাদক। আর মাদকের সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। এদিকে অবৈধ অস্ত্র, অর্থ আর রাজনৈতিক প্রভাবে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে এই মাদক মাফিয়ারা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখন তাদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। মাদকের ডেরায় অভিযান চালালেই মাদক মাফিয়ারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংসের মাদক ব্যবসার প্রসার হচ্ছে দ্রুত।

ঘরের দরজায় ইয়াবা : ফার্মগেটের তরুণ সাহাবুদ্দিন। ইয়াবায় আসক্ত। এক সময় এ তরুণকে ইয়াবা জোগাড় করতে বহুদূর যেতে হতো। কখনো পুরান ঢাকা, কখনো টঙ্গী। কয়েক মাস পর সাহাবুদ্দিন খবর পায়, পল্টনে পাওয়া যায় ইয়াবা। বছর খানেক পর সাহাবুদ্দিন ধানমন্ডিতে পেয়ে যায় ইয়াবা। সেখানেই পরিচয় আরেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তার কাছ থেকে খবর পায়, এতদূরে নয়, ফার্মগেটে আছে ইয়াবা। ফার্মগেটের সাহাবুদ্দিন ফার্মগেটেই পাচ্ছেন ইয়াবা। আর কদিন পর সাহাবুদ্দিনকে আর বাসা থেকে   বের হতে হয় না। ঘরের দরজার কাছে চলে আসে ইয়াবা। আগে ইয়াবা যোগাড় করতে ঘুরতে হতো, এখন ইয়াবা নিজেই চলে আসছে হাতের মুঠোয়। ইয়াবার এমন  সহজলভ্যতার চিত্র এখন সারা দেশে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন নারী মাদক ব্যবসায়ী। যা মোট মাদক ব্যবসায়ীর ১৭.৬ শতাংশ। এসব নারীর বয়স ১৫ থেকে ৬০। এ ছাড়াও নারীরা মাদক বহনে ৪০ শতাংশ শিশুকে ব্যবহার করে। প্রতিদিন ৬ কোটি টাকার ব্যবসা করে। আর ২০১৫ সালে দেশে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ৯৫ হাজার ৪০০ জন। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায়  ১ লাখ ৩০ হাজার ১০ জনে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা  বেড়ে ১ লাখ ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা  গেছে, গত ১ বছরে দেশে মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা  বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৯০ জন। তবে কক্সবাজার জেলায় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। সেখানে কমপক্ষে সাড়ে ৬ হাজার পুরুষ ও নারী মাদক ব্যবসায় জড়িত।

বরিশালে ফেসবুকে অর্ডার দিলে আসে মাদক : বরিশাল থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, মরণঘাতী মাদক ইয়াবায় ছেয়ে গেছে বরিশাল বিভাগের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রামপর্যায় পর্যন্ত। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় সর্বনাশা ইয়াবা। মুঠোফোনে কিংবা ফেসবুকে অর্ডার দিলে গোপনে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক। এ ছাড়া হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, প্যাথেড্রিন, মরফিন, টিডিজেসিড, অ্যালকোহল (মদ) এবং ড্যান্ডি পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালেই। দিন দিন মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে এবং এতে পরিণতি ভয়াবহ হচ্ছে উল্লেখ করে বরিশালের মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘সেইভ দ্য লাইফ’ এর চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান সুমন বলেন, বর্তমানে প্রচলিত মাদকের মধ্যে ‘ইয়াবা’ মোস্ট পপুলার। আজকের ইয়াবাসেবী কালকের ইয়াবা ব্যবসায়ী। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে ইয়াবাসেবী ও বিক্রেতার সংখ্যা। জানা যায়, কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন পরিবহনে এবং লোকমাধ্যমে বরিশালে ইয়াবা চালান আনা হয়। ফেনসিডিল আসে যশোর, সাতক্ষীরাসহ ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনে এবং লোক মারফত। গাঁজার চালান আসে কুমিল্লা এবং নোয়াখালী থেকে সড়ক ও নৌপথে। নেশাজাতীয় ইনজাকশন প্যাথেড্রিন, মরফিন ও টিডিজেসিড পাওয়া যায় চিহ্নিত কিছু ফার্মেসিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসারও অভিযোগ রয়েছে। গত প্রায় ১ বছরে বরিশালে ইয়াবাসহ পুলিশের দুজন সদস্য আটক হয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। মাদকের মামলায় বরিশালে কারান্তরীণ রয়েছেন শিল্প পুলিশের এসআই চিন্ময় মিত্র। এ ছাড়া মাদকসেবীদের ধরে মামলা দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পুলিশের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

সিলেটজুড়ে বিস্তার : সিলেট থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ভারত ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে স্রোতের মতো আসা মাদকের জাল এখন সিলেটের সর্বত্র। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই মাদকের ভয়ঙ্কর ছোঁবল। আর সিলেটে বর্তমানে অভিনব পন্থায় মাদক বিক্রি করা হচ্ছে। সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা সেজে একেবারে ঘর পর্যন্ত মাদক পৌঁছে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। একসময় বখে যাওয়া যুব সমাজই ছিল মাদকের প্রধান সেবনকারী। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, অভিজাতপাড়ার সন্তান, স্ত্রীরাও মাদকের ছোবলে আক্রান্ত। জানা যায়, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট সীমান্ত দিয়ে মদ, বিয়ার, হুইস্কিসহ বিভিন্ন ধরনের মদ ভারত থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসে মাদকচক্র। জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ঢুকে ফেনসিডিল। এ ছাড়া ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা থেকে বাস ও ট্রেনে বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে সিলেটে আসে হেরোইন, চট্টগ্রাম থেকে আসে ইয়াবা।

ট্রানজিট পয়েন্ট বৃহত্তর চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান,  ভৌগোলিক ও মাদকের আন্তর্জাতিক রুটের কাছাকাছি অবস্থানের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম মাদক পাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজার থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকার কমপক্ষে ৭০ পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশ করছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, আফিম, গাঁজাসহ হরেক রকমের মাদক দ্রব্য। এসব মাদক পাচারের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা, ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী। এমন কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যও রয়েছে এসব মাদক সিন্ডিকেটে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদক পাচারের ল্যান্ডিং পয়েন্ট চট্টগ্রামের নৌবন্দর এবং স্থলপথে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে আসছে মাদকদ্রব্য। চট্টগ্রামে হয়ে পাচার হওয়া মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম, মরফিন, কোডিন, মারিজুয়ানা, চোলাই মদ। বৃহত্তর চট্টগ্রামে ইয়াবা, গাঁজা এবং ফেনসিডিল এ তিন মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বড় ও মাঝারি মানের কমপক্ষে ১০০ সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটে জড়িত রয়েছে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা সারা দেশে পাচারের একমাত্র রুট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে চট্টগ্রাম। সড়ক ও নদীপথে টেকনাফ, কক্সবাজার থেকে ইয়াবা চট্টগ্রামে আসছে। পাশাপাশি মিয়ানমার হয়ে নদীপথে আসছে কোকেন, মারিজুয়ানা, মরফিন এবং বিদেশি মদ। মিরসরাই, খাগড়াছড়ি, ফেনী, আখাউড়া, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে ভারত থেকে আসছে আফিম, হেরোইন ও ফেনসিডিল। এসব মাদক সড়ক এবং রেলপথে পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। চট্টগ্রামে যত গাঁজা আসে তার ৮০ ভাগই আসে রেলপথে। দেশি মদ হিসেবে পরিচিত চোলাই মদ আসে তিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে।

চট্টগ্রাম মেট্রো মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান মাদক গোল্ডেন ট্রায়াংগেল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের কাছাকাছি এলাকায়। এ সুযোগ কাজে লাগাতে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান সিঙ্গাপুরসহ মাদক উৎপাদনকারী কিছু দেশ চট্টগ্রামকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই মাদক পাচারের ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। ফলে চট্টগ্রামে বিশ্বের প্রচলিত মাদকদ্রব্যগুলো সহজলভ্য হয়েছে।

রাজশাহীর তিন উপজেলায় জমজমাট কারবার : রাজশাহী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রাজশাহীর সীমান্তবর্তী তিন উপজেলা চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ীতে এখন রমরমা মাদকের বাণিজ্য। সম্প্রতি মাদকের চালান বহনে রাজশাহী অঞ্চলে যুক্ত হয়েছে নারীরাও। প্রতিদিন দুই একজন মাদক ব্যবসায়ী ও বহনকারীদের ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হলেও এর আওতায় পড়ছেন কেবল ক্ষুুদ্র মাদক ব্যবসায়ী ও বহনকারীরা। আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অবাধে মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে রাঘববোয়ালরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিদিনই চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ী এলাকার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে আসছে ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা। গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার হেরোইন আসছে। আর চারঘাট ও বাঘা সীমান্ত দিয়ে আসে ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবা। স্থানীয়দের অভিযোগ, গোদাগাড়ীতে পুলিশের তালিকায় থাকা অর্ধশত গডফাদার নির্বিঘ্নে হেরোইনের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত ৫ হাজারের বেশি বহনকারী। মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কিছু সদস্যের গভীর সখ্য থাকায় মাদকের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে তথ্য দিতে সাহস পায় না এলাকাবাসী।

খুলনায় ভয়াবহ আগ্রাসন : খুলনা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, খুলনা বিভাগের ৬ সীমান্ত জেলার শতাধিক রুট দিয়ে মাদক পাচার হয়। খুলনা-সাতক্ষীরা ও খুলনা-যশোর রুটে মাদকদ্রব্য চোরাচালান বেশি হয়। এ ছাড়া খুলনায় কোকেন ও হেরোইন চোরাচালানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেট জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। মাদক সেবীদের উৎপাত ও ইভটিজিং বেড়েছে চরম হারে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় প্রত্যন্ত এলাকাগুলো ইতিমধ্যে মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তবে চলতি মাসে সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা পর্যালোচনা বৈঠকে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকাভিত্তিক মাদক বিক্রেতাদের তালিকা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আচমকা অর্থবিত্তের মালিক হওয়া খুলনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি মূলত মাদকের কারবারি। এদের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। বিকিকিনিতে যুক্ত আছে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তরুণ-যুবক ও ছাত্ররা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তারাও এদের সহযোগিতা করে।

উত্তরাঞ্চলে মাদকের হোম সার্ভিস : রংপুর মহানগরসহ উত্তরাঞ্চলের গ্রাম-গঞ্জের তরুণ-তরুণীরা এখন আসক্ত হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবায়। এগুলো ‘বাবা’, ‘ছোট’ ও ‘গুটি’ নামে পরিচিত। রংপুর অঞ্চলে পাইকারি বিক্রেতার হাত হয়ে তা যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতার কাছে। খুচরা বিক্রেতারা দিচ্ছেন ‘হোম সার্ভিস’।   ফোন করলেই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এই মাদক। আর মাদশের সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। শুধু বাবা নয়, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা ফেনসিডিল,  হেরোইন, গাঁজা, বাংলামদ, ড্যান্ডি, বিভিন্ন জাতের মিশ্রণে তৈরি ঝাক্কি-১. ঝাক্কি-২, মিকচার-১সহ নানা ধরনের মাদক। তবে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন  বেশি জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবায়। মাদকে আসক্ত হচ্ছেন একশ্রেণির পুলিশ সদস্য, মাঝবয়সী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। জানা গেছে, রংপুরের প্রধান চার-পাঁচ জন মাদক ব্যবসায়ী রাজশাহীর চরাঞ্চল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হিলি, পলাশবাড়ী,  গোবিন্দগঞ্জ, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, হারাগাছ, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তপথে মাদক নিয়ে আসেন।

সীমান্ত পেরিয়ে যেভাবে আসে ইয়াবা : গোয়েন্দা ও স্থানীয় সূত্র বলছে, শুধু বাংলাদেশে পাচারের জন্যই মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় গড়ে  তোলা হয়েছে ৩৮টি ইয়াবা কারখানা। এ সব কারখানা  থেকে প্রতিদিন ৩০ লাখেরও বেশি ইয়াবা ঢুকছে  টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্তের ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে। মিয়ানমারের মংডু হতে বিভিন্ন প্রকার ফিশিং  বোটের মাধ্যমে টেকনাফের স্থলবন্দর, শাহপরীর দ্বীপ, মাঝিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, ট্রানজিট ঘাট, নাইট্যংপাড়া, সাবরাংয়ের লেজিপাড়া ও বার্মাপাড়া পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই ঢুকছে লাখ লাখ পিচ ইয়াবা। এসব এলাকা থেকে বিলাসবহুল গাড়িতে ‘প্রেস’, আইনজীবী, ‘সাংবাদিক’ বিভিন্ন এনজিও এমনকি জাতিসংঘ’র শরণার্থীবিষয়ক দফতরের স্টিকার লাগিয়েও অহরহ ইয়াবা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

মিয়ানমারে ৩৭ কারখানা : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে বিজিবির পাঠানো মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির কারখানাসংক্রান্ত গোপন তালিকায় দেখা যায়, মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় রয়েছে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এসব কারখানা বাংলাদেশি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থে স্থাপন করা হয়েছে। ট্রলারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নাফ নদ পেরিয়ে টেকনাফে ঢুকছে এসব মাদক। কখনো পুলিশ প্রটেকশনে, আবার কখনো অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ন্ত্রণে। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের  কোচিন প্রদেশে রয়েছে ১০টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন  কোচিন ডিফেন্স আর্মি। এ কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা উৎপাদিত হয় বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের  গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গম নামখাম এলাকায় দুটি কারখানা রয়েছে। এ দুটি নিয়ন্ত্রণ করে পানহেসি কেও মেও ইয়াং মৌলিয়ান গ্রুপ। মিয়ানমারের কুনলং এলাকায় হাউ স্পেশাল পুলিশ ট্র্যাক্ট গ্রুপের অধীনে আছে বড় আকারের একটি ইয়াবা কারখানা।

৬০ ভাগ মামলার আসামি খালাস : আশ্চর্য হলেও সত্য যে, মাদক মামলার ৬০ ভাগ আসামিরই সাজা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পুলিশের করা মাদক মামলা বিচারের রায়ে সাজা ও খালাস পাওয়া আসামিদের পরিসংখ্যান  থেকে এমন তথ্য মিলেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মামলাগুলোর বিচারেও খালাস পাচ্ছে অর্ধেকের বেশি আসামি। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে  দেশের আদালতগুলোতে সাত হাজার ১৩৪টি মাদক মামলার বিচারের রায় দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিন হাজার ৮২টি মামলায় সাজা হয়েছে তিন হাজার ৬৯০ আসামির। ওই সময়ের মধ্যে চার হাজার ৫২টি মামলায় খালাস পেয়েছে পাঁচ হাজার ৪৬৩ জন আসামি। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে ওই সংস্থার করা মামলাগুলোর রায়ে ৫৫ ভাগ এবং ২০১৬ সালে ৫৬ ভাগ মাদক মামলার আসামিই খালাস পেয়ে গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এরপরও আমরা আমাদের সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিদিনই মাদক উদ্ধার হচ্ছে। নিজের অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, তবে কয়েকদিন আগে আমরা জেনেভা ক্যাম্পের মাদক সম্রাটকে গ্রেফতার করেছিলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই সে জামিনে বের হয়ে এসেছে। এমন প্রায়ই ঘটছে।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ্ উদ্দীন আহমেদ বলেন, মাদক আইনে ইয়াবাকে এখনো ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে কি দেখা হয়েছে? যেখানে হেরোইনের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে সেখানে ইয়াবার অবস্থান কোথায়?

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন