দেশ ও ধর্মের আলাদা সত্ত্বা থাকা উচিত : আদোনিস
---
নিউজ ডেস্ক : দেশ ও ধর্ম আলাদা সত্তা হিসেবে টিকে থাকা উচিত। কিন্তু আরব দেশগুলোসহ বিশ্বের অনেক দেশেরই অন্যতম প্রধান সমস্যা, সেখানে ধর্ম আর রাজনীতিকে অভিন্ন করে রাখা হয়েছে। ফলে একটির দুর্বৃত্তায়নে দুটিই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
আরবের আধুনিক সাহিত্যধারার অন্যতম পথিকৃৎ ও সিরিয়ার খ্যাতিমান কবি আদোনিস আরব দেশগুলো সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে এ কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনের ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রথম সেশনে আরব সাহিত্য, রাজনীতি এবং নিজের প্রসঙ্গে তিনি খোলামেলা আলোচনায় এ কথা বলেন।
এ সেশনের সঞ্চালনা করেন সাহিত্যিক ও অনুবাদক কায়সার হক। দর্শকদের জন্য ফরাসি ভাষা থেকে আদোনিসের ভাষ্যের অনুবাদ করেন অধ্যাপক আশরাফুল হক চৌধুরী।
আরব দেশগুলোতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনো প্রতিষ্ঠিত নয় উল্লেখ করে আদোসিন বলেন, রাষ্ট্রের যে সমাজকাঠামো, তার ভিত্তি হওয়া উচিত মানবাধিকার, স্বাধীনতার চেতনা এবং নারীর স্বাধীনতা।
আদোনিস বলেন, নতুন পঠন-পাঠন দরকার সকল প্রাচীন কাব্য সাহিত্যেরই। এ ব্যাপারে তিনি ও তাঁর সমসাময়িক আরব লেখকরা কাজ করে যাচ্ছেন। এতে বিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তাঁদের ঘরানার পত্রিকাগুলো।
সিরিয়ার এ কবি জানান, আর এ জন্য তাঁরা ভালো পাঠক গড়ে তোলার দিকে জোর দিয়েছেন। কারণ মাঝারি মানের পাঠক ভালো সাহিত্যকেও মাঝারি মানে নামিয়ে আনে।
সেশনের শুরুতে সঞ্চালক কায়সার হক দর্শকদের সঙ্গে সিরিয়ার কবি আদোনিসকে পরিচয় করিয়ে দেন। তবে এরপর কবি তাঁর নিজের গল্প নিজেই বলেন। কীভাবে তিনি আলী আহমেদ সাঈদ থেকে আদোনিস হয়ে উঠেছেন। সিরিয়ায় তিনি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন পত্রিকাগুলো তাঁর একটি কবিতাও ছাপেনি। তখন তিনি ভাবলেন, গ্রিক দেবতা আদোনিস যেমন আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তিনিও হয়তো পত্রিকার সম্পাদকদের দ্বারা তেমনি আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই আদোনিসের নামই নিজের পেননেম বা ছদ্মনাম হিসেবে গ্রহণ করেন। আর তার পর থেকেই তাঁর কবিতাগুলো পত্রিকায় ছাপা হতে শুরু করে। অবশ্য পত্রিকার লোকজন তাঁকে দেখার পর, তাঁর জীর্ণশীর্ণ চেহারা-পোশাক দেখে শুরুতে তাঁকে আদোনিস বলে মানতেই রাজি হননি।
আদোনিস জন্মেছিলেন সিরিয়ার এক অনুন্নত গ্রামে। যেখানে বিদ্যুৎ, পানি ও স্যানিটেশনের আধুনিক কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ছোটবেলায় পড়েছিলেন মক্তবে (কুত্তাব)। সেখানে তাঁকে কোরআন পড়তে হয়েছিল। তবে বাবার কল্যাণে পরিচয় ঘটে আরবের কবিতার সঙ্গে। দ্রুতই তিনি কাব্যের প্রেমে পড়ে যান। জন্মদাত্রী মায়ের পাশাপাশি কাব্যজগৎ হয়ে ওঠে তাঁর দ্বিতীয় মাতৃমূর্তি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি সিরিয়ান সোশ্যাল ন্যাশনালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। পরে সে জন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন, স্বাধীন কাব্যচর্চা চালিয়ে যেতে হলে তাঁকে দেশ ছাড়তে হবে। তাই তিনি পাড়ি জমান লেবাননে। সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই। তবে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে- ‘দ্য সংস অব মিহিয়ার অব দামাস্কাস’।
প্রাচীন আরব সাহিত্যের সঙ্গে আদোনিস মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়েছেন আধুনিকতার। আর এ কারণেই তিনি আধুনিক আরব কবিতার পথিকৃৎদের একজন হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি সমসাময়িকদের সঙ্গে নিয়ে মিস্টিক মুভমেন্টেরও সূচনা করেন। তাতে গুরুত্ব পায় দুটি বিষয়- ঈশ্বর ও আরবদের সাংস্কৃতিক সত্তা। আরবদের এ সত্তার ধারণার মধ্যে ছিল এক্সিসটেনশিয়ালিজমের ছায়া। আর এ ধারার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে নতুন করে আরবদের অস্তিত্বকে জানান দেয়।
সুফিজম ও সুরিয়ালিজমের মধ্যে মিল আছে কি না, কায়সার হকের এমন প্রশ্নে এ বিতর্ক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন জানিয়ে আদোনিস বলেন, তাঁরা শুরু থেকেই অন্যান্য সাহিত্য ও সাহিত্যধারা সম্পর্কে উদার মন নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই সঙ্গে আরবি সাহিত্যও নতুন করে পাঠ করেন। তাঁরা আবিষ্কার করেন, পাশ্চাত্যে সুরিয়ালিজমের চর্চা শুরু করার হাজার বছর আগেই আরবে কাছাকাছি ধরনের সুফিজমের চর্চার চল ছিল। এমনকি সুরিয়ালিজমে নারীবাদের যে ধারণা আছে, আরবের সুফিজমেও সেটি ছিল।
নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে আদোনিসের সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি, তিনি বামপন্থী। কারণ তিনি সব সময় মানুষের পক্ষে। এবং তিনি বিশ্বাস করেন মানুষ সব সময়ই একধরনের পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তারা কখনই কোথাও থমকে থাকবে না।
বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে আদোনিস বলেন, এ বিষয়ে তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট নন। মানুষ এখন আর ফুলের সুবাসের প্রতি নয়, আকৃষ্ট হয় ফুলের প্রতিই। আর আমেরিকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুল, টাকার বিচারে এবং ক্ষমতার বিচারেও। তবে মানুষের পড়ার অভ্যাস নিয়ে তিনি মোটেই হতাশ নন, বরং বেশ আশাবাদী। কারণ মানুষ আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি বিষয় নিয়ে পড়ে। পাশাপাশি তারা কেবল বইতেই সীমাবদ্ধ নয়, পড়ছে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে।
কবিতার এক্সপ্রেশন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আদোনিস মুহূর্তের মধ্যেই এক অনুপম শব্দালংকার সৃষ্টি করেন এবং বলেন, দরজা খোলার বিবরণ এভাবেও দেওয়া যেতে পারে, একজন মেয়ে দুই বাহু বাড়িয়ে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
সেশন শেষ হয় উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়ে। সে পর্বে আদোনিস নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করে উপস্থিত দর্শকদের বিমোহিত করেন।-বাসস