রোহিঙ্গাদের রক্তবন্যা আর চোখের জলে ভাসা জীবনের শেষ কোথায় ?
---
আল আমীন শাহীন : হিজাবে বোরখায় ঢেকে থাকা মুখমন্ডলে শুধু দুটি চোখ খোলা, নিদ্রাহীন ক্লান্ত চোখ ফুলে আছে,দেখলেই বোঝায় যায় চোখের জল শেষ হয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা চোখও যেন সামান্য আশ্রয় পেয়ে শক্তি পেয়েছে। ভাষা নেই মুখে, নেই কোন আবদার, কথা, শুধু উদাস গন্তব্যহীন দৃষ্টি। কি হয়েছে , কেমন আছে ? এমনই প্রশ্নে কারো কারো চোখ দিয়ে ঝড়ে পড়ে এক দু বিন্দু জলের ফোটা। সেই জলের ফোটায় ভেসে উঠে বর্তমান সময়ে বিশ্ব সভ্যতার লজ্জার অধ্যায় ,মায়ানমারে মানবিক চরম বিপর্যয়ের করুণ দৃশ্যপট। রোহিঙ্গা ট্রাজিডির শিকার লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষ শিশুর চোখ দেখেছে সভ্যতার লজ্জাজনক ধ্বংস যজ্ঞ। কোমলমতি শিশু যারা তাদের চোখে মুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তি আর দৃষ্টি। সদ্য জন্ম নিয়ে শিশুদের শরীর থেকে মুছেনি খুন হওয়া পিতা মাতার রক্তের দাগ। আগুনে পোড়া ঘরবাড়ির চিহ্ন লেগে আছে কারো কারো পোষাকে। এক দুফোটা চোখের জল শেষ হয়নি যাদের, তাদের চোখের জলে ভেসে উঠছে মিয়ানমারের বর্মী মগ হায়েনা সেনা সহ রক্তপিপাসুদের অমানবিক নির্যাতনের স্মৃতি। মা বাবার সামনেই হত্যা করা হয়েছে সন্তানকে, সন্তানের সামনেই জবাই করে রক্ত নিয়ে খেলা করেছে হায়েনারা। পাশবিক ধর্ষণ হত্যা নির্যাতন। দীর্ঘদিনের প্রিয় আবাসন ধ্বংসের আগুণের লেলিহান শিখা, নির্বাচারে গুলি, বর্বরদের হত্যাকারীদের রক্ত আর লাশ নিয়ে জয়উল্লাস। ধাবিত গুলি, ধাড়ালো অস্ত্রের ঝনঝনানী থেকে কোনভাবে প্রাণে বেঁচে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চোখে মুখে তাকানো যায়না।
মায়ানমার থেকে নির্যাতিদের এ দেশে আসা জন¯্রােত ভুলে গেছে শোকের মাতম, বাক রুদ্ধ তারা, অব্যক্ত চাহনীতেই যেন ওরা বলছে, আর কত রক্তবন্যায়, আর কত লাশের পাশে আর কত চোখের জলে ওরা ভাসবে। গন্তব্যহীন এ পথচলার শেষ কোথায় ? কবে পাবে তারা একটু শান্তিতে থাকার শেষ ঠিকানা? শিক্ষা সভ্যতা আর তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতিতে নানা নানা মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের করুণ দৃশ্য দেখেছি , প্রত্যক্ষভাবে দেখার ইচ্ছায় গিয়ে ছিলাম কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিংবদন্তী জনমানুষের প্রিয় নেতা সাবেক উপমন্ত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী আলহাজ্ব এডভোকেট হুমায়ূন কবীর মানবপ্রেমে ঘনমমত্বে কিছুদিন আগে আহবান জানালেন , যেতে হবে রোহিঙ্গাদের পাশে। প্রেস ক্লাবে একটি সভায় মিলিত হয়ে যাবার প্রস্তুতি শুরু হলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে স্থানীয় সাংবাদিক সুধীজনকে নিয়ে হলো প্রস্তুতি সভা, সভায় জননেতার বিষয়টি উপস্থাপন করলাম আমি। সকলকেই ঐক্যমত পোষণ করে আলহাজ্ব এডভোকেট হুমায়ূন কবীরের নেতৃত্বে প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন জামির সমন্বয়ে সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের ব্যানারে রোহিঙ্গাদের পাশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চ’ড়ান্ত হলো। একাজে সমন্বয়ে অনন্য অবদান রাখলেন অধ্যক্ষ সোপানুল ইসলাম, আলহাজ্ব এডভোকেট লোকমান হোসেন সাংবাদিক নজরুল ইসলাম শাহজাদা, জাকারিয়া জাকির,আজিজুর রহমান পায়েল, শেখ আবদুল কাইয়ূম সহ বেশ কয়েক জন। সহায়তা ফান্ড সংগ্রহ করে ট্রাকে ভর্তি মাল নিয়ে আমরা গেলাম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে। সফর সঙ্গী অন্যান্যের মধ্যে মাওলানা মুফতি হেদায়েতুল্লাহ নূর, শিক্ষক মনিরুল হক নিপু, সাংবাদিক মনিরুজ্জামান পলাশ, এসএম মুকিত। উখিয়া নোয়াপাড়া মুচনী হ্নিনা ত্রাণ গোডাউনে পৌছেই দেখা পেলাম সেই নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গাদের। দেখলাম তাদের সেই বেদনাভরা দৃষ্টি , জমে থাকা চোখের জল। পবিত্র আশুরার তারিখ ছিল সেদিন। বর্তমান জমানার রোহিঙ্গা মুসলিমদের দেখেই অনুভব করেছি কারবালার মতোই শোক বেদনা। মুফতি সাহেব যখন মোনাজাত ধরলেন চোখের পানি থামাতে পারলেন না কেউ। সহমর্মিতায় আলহাজ্ব হুমায়ূন কবীর সহ সকলের চোখে ছিল বেদনার কান্না। হ্যাংকং বাজারে বসেছিলাম কিছুক্ষণ সেখানে কথা হলো স্তানীয় এক ব্যবসায়ীর সাথে তার কাছ থেকে পেলাম নানা তথ্য। বাজারটি থেকে মায়ানমারের সীমানা ৫ মিনিটের পথ, সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম সীমানার ওপারে একাধিক স্থানে ধূয়ার কুন্ডলী মায়ানমারে জ্বলছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর। একটি লাশ ভেসে এসেছে সেদিন মাথাবিহীন, শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত বিক্ষত। ঐ ব্যবসায়ী বল্লেন, শুরু থেকে এদিন পর্যন্ত বিভৎস পাশবিক নির্যাতনের নানা স্মারক কথা।
সীমানার কাছে গেলেই লাশ পচা গন্ধ, আটকে পড়াদের শোর চিৎকার। এপারে এসে প্রাণে বাঁচার আকুতি। ঐ সীমানা দিয়ে সেদিনও প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে। সবাই বাড়িঘর সাজানো সংসার সর্বস্ব ফেলে, কেউ কেউ পিতামাতা , স্বামী সন্তান পুত্র কন্যা, কোলের শিশুর লাশ দাফন ছাড়া ফেলে, রক্তবন্যায় পা ফেলে প্রাণ, ইজ্জত, সম্ভ্রম বাঁচাতে সীমানা পেরিয়ে এসেছে। না খেয়ে ১৫-২০ মাইল হেটে, কোলের শিশু নিয়ে মা,বয়স্ক শিশুদের কাঁধে নিয়ে কেউ কেউ এসেছে গন্তব্যহীন পথযাত্রায়। নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে তাদের সাথে। এ সীমানায় পথের পাশে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক রোহিঙ্গাকে দেখলাম। সেনাসদস্যদের সহায়তায় একটি আশ্রয় শিবিরে পৌছে দেখি কাঁদা ভরা মাটির উপর বাঁশ পলিথিনের ছাউনিতে শত হাজার রোহিঙ্গা। আলহাজ্ব এডভোকেট হুমায়ন কবীর রিয়াজউদ্দিন জামির নেতৃত্বে সেখানে নগদ অর্থ বিতরণ করতে গিয়ে দেখি করুণ দৃশ্যপট। এই ক্যাম্পে কাঁদায় মাটিপানিতে সদ্য জন্ম নিয়েছে একটি শিশু। কাঁদা পানির উপরেই শিশুটিকে বুকে আগলে বসে আছে মমতাময়ী মা । সেখানকার আশ্রয় ক্যাম্পে এমনই ৬ টি শিশুর জন্ম হয়েছে সেদিন দেশ ঠিকানার পরিচয়বিহীন। প্রসূতি অনেকেই নির্বাক দাঁড়িয়ে, দেখা পেলাম একই পারিবারের ৩ বোনের। চোখের সামনেই বর্মী মগেরা হত্যা করেছে তাদের পিতামাতাকে। কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি না বুঝার কারণে। ভাষা আলাদা তাদের বেদনা বলার আশ্রয়ও পাচ্ছে না তারা। দুভাষীর মাধ্যমে রোহিঙ্গা এক যুবকের সাথে কথা হলো, সে জানাল, মাস দুয়েক পূর্বে বর্মীসেনারা অভিযান চালিয়ে ঘরের ব্যবহারের দা লাঠি ধাড়ালো যা আছে সব নিয়ে গেছে, বন্দী করে নিয়েছে তরুণ যুবা সহ নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গাদের। পরে সেনারা রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে গুলি করে আর বর্মী মগেরা ধাড়ালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে হত্যা নির্যাতন বাড়ি ঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে। হামলা নির্যাতন হত্যার বিভৎস বর্নণায় চোখের পানি ঝড়েছে আর বুকের মাঝে ছিল বর্মী হায়েনাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা।
দিনভর ঘুরেছি সেখানকার আশ্যয় ক্যাম্প সহ আশে পাশে। রোহিঙ্গাদের পাশে গিয়ে একবারও পেটে দানা পানি দেয়ার মতো সামন্য ইচ্ছেও জাগেনি। আলহাজ্ব এডভোকেট হুমায়ূন কবীরের সময়োপুযুক্ত আহবানে এবং মানবতার কল্যাণে প্রয়োজনীয় একটি সফরে সুযোগ পেয়ে ব্যতিক্রমী সময় কাটিয়েছি। সফর থেকে ফেরার পথে দেখেছি পথে পথেই শরনার্থীদের সহায়তা সামগ্রী নিয়ে যাওয়া বাঙ্গালিদের ট্রাকের সারি। মানবতার কল্যাণের জন্য আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসেছে মানবপ্রেমী মানুষ। মনের গহীন থেকে তাদের ধন্যবাদ দিয়েছি আর সবার প্রতি আহবান জানিয়েছি জানাচ্ছি, আসুন মানুষের বিপদে প্রকৃত মানুষ হয়ে আমরা সবাই অসহায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াই। দুই দিন কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখেছি এখনো আসছে রোহিঙ্গারা রক্ত বন্যা আর চোখের জলে পার হয়ে নাফ নদী। নিজ দেশ থেকে পরদেশে কতদিন ? বিশ্ব বিবেকের কাছে জানতে চাইছি গন্তব্যবিহীন রোহিঙ্গাদের এ যাত্রার শেষ কবে। নিজ দেশে তাদের স্থায়ী ঠিকানা হবে কবে ?
লেখক : সিনিয়র সহ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব, সম্পাদক নতুন মাত্রা।