ভালবাসার এপিঠ-ওপিঠ
---
লিখেছেন-মুশতারী মমতাজ মিমিঃ লাশের হিমাগারে ঢুকতেই শিঁড়দাড়ায় শীতল অনুভূতি বয়ে গেলো। এটা অবশ্য হিমাগারের নিম্নতাপমাত্রার জন্যেও হতে পারে। আমি একজন মেডিকেল অফিসার। পেশাগত দ্বায়িত্বের খাতিরে এর আগেও বহুবার আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। প্রথম প্রথম নিথর মরাদেহগুলো দেখে খুব কষ্ট হতো এটা ঠিক তবে ভয় আমার কখনোই লাগে নি। কিন্তু আজ ভয় লাগছে, প্রচন্ড ভয় লাগছে। হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে গেছে বুঝতে পারছি। হিমঘরের নিম্ন তাপমাত্রাতেও আমি কুলকুল করে ঘামছি। লাশ রাখার ফ্রিজগুলোর ইঞ্জিন থেকে গুমগুম শব্দ হচ্ছে। শব্দটা স্নায়ুকে দূর্বল করে দিচ্ছে আরো।
কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগোচ্ছি। আমার দুপাশে দুজন ডিউটি পুলিশ, পেছনে আমার সহকর্মী। কোনার ফ্রীজটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পুলিশ দুজন তিন নম্বর তাকটা টেনে বের করলো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো। কবীরের দেহটা নিথর হয় পড়ে আছে। মুখের উপর হালকা হালকা বরফ কুচি। চোখ বন্ধ। আবছা আলোয় ওর লাশটা নীলচে লাগছে। এই মানুষটার সাথে দুদিন আগেও আমি রিকশায় ঘুরেছি। আজ ও হিমঘরে। ওকে মাটি দেয়া হবে একটু পর। আত্নীয়-স্বজনরা লাশ নিতে এসেছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম!
রিংটোন বাজছে। আমি ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠলাম। স্বপ্ন দেখছিলাম এতোক্ষণ। বালিশ ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই কবীরকে নিয়ে এরকম দুঃস্বপ্ন দেখি। ঘুমের মধ্যেই কেঁদেকেটে একাকার হই। আমি যতই অস্বীকার করি না কেন কোথায় যেনো একটা টান রয়ে গেছে ওর প্রতি। অথচ কবীর দিব্যি ওর সুন্দরী বউ নিয়ে সুখে আছে!
জোর করে ফিক করে হেসে দিলাম আমি। অন্যের বরকে ভেবে কষ্ট পাবার মানে নেই।
কল বেজেই যাচ্ছে। মা ফোন দিয়েছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কেটে দিয়ে পাশ ফিরে শুলাম। দেখি বাপ্পী বিছানায় নেই।বুঝলাম প্রতিদিনের মতো আজকেও কবীরকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে উল্টাপাল্টা বকেছি আর কেঁদেছি। বাপ্পী সেটা শুনে বেলকনিতে গিয়ে চুপচাপ বসে বসে আছে।
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ন’টা বাজে…
বেডসাইড থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম। ইনবক্সে লোকজন ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আজ যে চৌদ্দ ফেব্রুয়ারী মাথাতেই ছিলো না। গতবছর জুনে আমার ইন্টার্ণ শেষ হয়েছে। আটমাস ধরে বিসিএস আর পোষ্টগ্রাজুয়েশনের জন্য বাসায় পড়াশোনা করছি। অফিস আদালতের বালাই নেই বলে বার, তারিখ এসব মনে রাখার প্রয়োজন হয় না। কোন দিবস গেলে টেরই পাই না বলতে গেলে। ডাটা কানেকশন অফ করে দিয়ে ফেসবুক থেকে বের হয়ে আসলাম। দুবছর আগের এই দিনটার কথা মনে পড়ে গেছে। কোনমতেই আর ভাল থাকা সম্ভব নয় সারাদিন…
১৪ ফেব্রুয়ারী।আজ আমাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। দু বছর আগের কথা। কবীরের সাথে সম্পর্কের কথা জানাজানি হওয়ার পর বাসায় তখন তুলকালাম অবস্থা। এদিকে কবিরের সাথেও প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া-ঝাটি হচ্ছিলো। একরকম বাধ্য হয়েই কবীরের জীবন থেকে সরে আসলাম। কথাটা কিভাবে যেনো আব্বু-মার কানে চলে গেলো। তারা এটাকে মোক্ষম সুযোগ মনে করে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য গরু খোঁজার মতো করে পাত্র দেখা শুরু করলেন।
১৩ ফেব্রুয়ারী বৃস্পতিবার ছিলো সে বছর। তার উপর পহেলা ফাল্গুন। রুমমেটকে আমাদের এলাকা দেখানোর জন্য বাসায় নিয়ে গেলাম। বাসায় পৌঁছানোর এক ঘন্টাও হয় নি। আম্মু ঘোষণা দিলো পরদিনই (14 Feb) আমার বিয়ে। আগে বললে আমি বাসায় আসতে নাও পারি ভেবে আমাকে জানানো হয় নি। বরপক্ষকে কথাও দেয়া হয়ে গেছে। আমার না বলার কোন সুযোগই ছিল না। পরিবারের মানসম্মান রক্ষার্থে বিয়ের সম্মতি দিয়েছিলাম আমি। কবীরকে ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু তখনও মনে-প্রাণে কবীরকেই চাইতাম পাগলের মতো। বিয়েটাকে তাই গলার কাটা মনে হলো। বাপ্পীকে সহ্যই করতে পারলাম না কোন ভাবেই।
আমি তখন রংপুর মেডিকেলে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকি। বাপ্পীর বিসিএসের পোস্টিং গংগাচড়ায়। আমার হোষ্টেল থেকে ৩০মিনিটের পথ। চাইলেই বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার শুরু করা যেতো। বাপ্পী রংপুর থেকে অফিস করতে পারতো। ও জোর করলে আমাকে বাধ্য হতে হতো। কিন্তু ওকে চাওয়ার সুযোগই দেইনি। অযুহাত দেখাতাম, সংসার করলে হোস্টেলে থেকে গ্রুপ স্টাডি করা হবে না। পড়াশুনার ক্ষতি হবে। এমনকি পাশ করার পরে ইন্টার্ণ করার সময়ও হোস্টেলে থেকেছি। ইন্টার্ণ করার আগে কয়েকবার তাও যাও বা চেষ্টা করেছিল, ইন্টার্ণ করার সময় আর কিছুই বলেনি। ও ততদিন বুঝে গেছে আর যাই হোক আমি না চাইলে কিছুই সম্ভব নয়। পাশ করার পর বিয়ের প্রথম রাতেই ওর আর আমার মাঝে একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছি আমি। এরপর দিনকে দিন সেই রেখাটা কেবল পুরুই হয়েছে। গত দুছরেও সেই সীমারেখাটা পার করে আসতে পারেনি ও। আমি ওকে বাধ্য করেছি। আরো কিছু সময় পরে বিয়েটা হলে হয়তো আমি মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু কবীরকে ভালবাসা অবস্থায় বিয়ে হওয়ায় আমার সবসময়ই মনে হতো ওর জন্যই কবীরকে পেলাম না আমি। আমাকে বিয়ে করে আমার ছয় বছরের প্রেমকে গলাটিপে হত্যা করেছে সে। আর যাই হোক আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি না।
ইন্টার্ণ শেষ হওয়ার পর আর কোন অযুহাত ছিলো না আমার কাছে। বাপ্পীও ততদিন রংপুর চলে এসেছে। বাধ্য হয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার পাততে হয়েছে। তবে ভাগ্যটা ভালো ছিলো যে বাসা নেয়ার সপ্তাহ খানেক পরেই ও ছয় মাসের জন্য একটা ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে ঢাকা চলে গেছিলো। ছ’মাস একা একা খেয়েছি-দেয়েছি আর পড়াশোনা করেছি। রোজ দুবেলা বাপ্পী ফোন করতো। আমি দায়সার কথা বলে রেখে দিতাম। কিন্তু গত দেড়মাস হলো ও বাসায় আছে। ট্রেনিং শেষ করে মেডিকেলে জয়েন করেছে। বাসা থেকে অফিস করে। জীবনটা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। যাকে ভালোবাসি না শুধুমাত্র বিয়ের জোরে তাকে দুবেলা রেঁধে খাওয়াই, গোসলের জন্য গরম পানি করে রাখি, মধ্যরাত পর্যন্ত গেট খুলে দেবার জন্য অপেক্ষা করি, এক খাটে ঘুমাই, এমনকি তার কাছে নিজেকে সঁপে পর্যন্ত দেই। চার দেয়ালের মাঝে এমনই অদ্ভুত জীবন আমার। এসব অবশ্য না করলেও মনে হয় বাপ্পী কিছুই বলতো না। ও আমাকে প্রচুর ভয় পায়। অনেকদিন রাগ করে দুপুরে কিংবা রাতে রাঁধিনি। ও প্রশ্ন পর্যন্ত করেনি। বাইরে থেকে খাবার এনেছে। কতদিন সারারাত পড়ে দুপুরবেলা ঘুম থেকে উঠেছি। ও ডাকেনি পর্যন্ত। তবুও কেন জানি নিতান্তই অপারগ না হলে আমি ওর প্রতি বউ হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকি না। কেন থাকিনা কে জানে। আমার মনে হয় গত দু বছর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলতে চলতে ইচ্ছে-অনিচ্ছাগুলো সব একই হয়ে গেছে…
তবে আজকাল কবীরকে ততটা মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে ও ফোন দেয়। হাই-হ্যালো হয়। এর বেশি কিছু না। শুধু যেদিন কবীর ওর বউকে নিয়ে ছবি আপলোড দেয় সেদিন কয়েকঘণ্টা আমার খানিকটা কষ্ট লাগে। তারপর আবার ওকে ভুলে যাই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বাপ্পীর সাথে কিছু ছবি তুলে আপলোড দেই। সবাই আমার বরকে দেখতে চায়। কিন্তু সাহস হয় না আমার। বাপ্পীকে এতো অবহেলা করেছি যে ওর কাছে দাঁড়াতে লজ্জা হয় খুব। বিনা দোষে একটা মানুষকে দুই দুইটা বছর দূরে ঠেলেছি, অপমান করেছি। বিয়ের প্রথম দিকে এমনকি ওর সামনেই কবীরের সাথে কথা বলেছি। ওকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছি পর্যন্ত। বাপ্পী নির্বিকার থাকতো। ওর সহ্য ক্ষমতা প্রচুর। আমি যত ওর প্রতি অসহিষ্ঞু হই ও ততই আরো ধৈর্য্যশীলতা দেখায়। একটা মানুষ এতোটা সহ্য করে কিভাবে? আর আমি কেনো ওর সাথে মানিয়ে নিতে পারিনা এটা ভেবে আমার আরো রাগ হয়। আমি আরো অন্যায় করে ফেলি ওর উপর। বিনিময়ে ওকে আরো নরম হিসেবে আবিষ্কার করি। আজকাল কেন জানি মনে হয় বাপ্পী একটু দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করলে আমার ভাল লাগবে। হয়তো উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না আমি আগের মতো অতো রিঅ্যাক্ট করবো। এটাকে আমি বাস্তবতা মেনে নেয়া বলবো নাকি দূর্বলতা বলবো ভেবে পাই না…
জানালা দিয়ে রোদ এসে মুখে পড়ছে। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। আড়মোড়া দিয়ে বিছানা ছেড়ে প্রতিদিনের অভ্যাস মতো বেলকুনিতে গেলাম। দেখি বাপ্পী নামাজ পড়ছে। গত বছর বিবাহবার্ষিকীর কথা মনে পড়ে গেলো আমার। সেদিন খেলতে গিয়ে আমার ছোট ভাইয়ের হাত কেটে গেছিলো। বাপ্পী তখন গংগাচড়ায় ছিলো। আমি বাপ্পীকে বারবার ফোন দিচ্ছিলাম ওষুধ নেয়ার জন্য। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে যখন লাষ্ট কল দিলাম ওর রুমমেট ফোন রিসিভ করলো। আমাকে বিবাহ বার্ষিকির শুভেচ্ছা জানিয়ে বলল বাপ্পী সকাল থেকে নামাজ পড়ছে আর কাঁদছে। আমি আর ওষুধ না চেয়েই লাইন কেটে দিয়েছিলাম। সেদিন খুব মন খারাপ হয়ে গেছিলো আমার।
আজকেও ও নামাজ পড়ছে। অথচ গত বছরের এই দিন এবং আজকে দুই দিনই এই দিনটার কথা আমার মনে পর্যন্ত পড়েনি!বেলকুনির দরজায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে চাইলাম। চোখ লাল হয়ে আছে ওর। আমার পায়ের শব্দ শুনে চোখ মুছেছে হয়তো।মোনাজাতে শেষ করে আমার দিকে তাকাল। মুচকি হেসে বলল-শুভ সকাল।
বেশ উচ্চস্বরে বললাম- শুভ সকাল না ছাই! তোমাকে বলেছি না আমি ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত জানালার পর্দা খুলবে না?
বাপ্পী কিছু বলল না।
বেলকুনির দরজাটা ধাম করে টেনে দিয়ে ফ্রেশ হতে চললাম আমি। কি মনে করে জানালার দিকে তাকালাম। দেখি জানালার গ্রিল থেকে এক ঝুড়ি ফুল ঝুলছে। রজনীগন্ধা, গাঁদা, কাঠগোলাপ আর শিমুল ফুল! সবার মাঝখানে দুটো বিশাল বিশাল লাল গোলাপ। তার উপরে একটা কাগজ ভাঁজ করা। এগিয়ে গিয়ে কাগজের ভাঁজ খুললাম। বাপ্পী লিখেছে –
“আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের বিয়েটা দুমাসও টিকিয়ে রাখবে না। সেখানে দু বছর হয়ে গেলো। এতগুলো সময় আমাকে সহ্য করার জন্য ধন্যবাদ। ফুলের ঝুড়িটা সরাসরি তোমার হাতে তুলে দিয়ে ‘ভালবাসি’ বলার সাহস হয়নি। তাই জানালার গ্রিলে রেখেছি যেন ঘুম ভাঙতেই তুমি দেখতে পারো। অবশ্য তুমি ফুল দেখার আগেই জানালার পর্দা খুলে দেয়ার জের তুলে আমার সাথে রাগারাগি করবে। তবুও রিস্কটুকু নিলাম। আজ একটা বিশেষ দিন। কতকিছুই তো হজম করেছি এতটুকুও পারবো। যাহোক, দু বছর পূর্তির জন্য অভিনন্দন মিসেস।
ভালবাসাসহ, -বাপ্পী
জানালার পর্দা তোলার জন্য ওকে বকা দেয়াতে লজ্জা লাগছে এখন। কাজটা ঠিক হয় নি। ওয়াশরুমে ঢোকার পর হুট করে মনে হলো আমারও নামাজ পড়া উচিত। পরক্ষণেই মাথা থেকে ভাবনাটা তাড়িয়ে দিলাম। আমার বিয়েটার জন্য আমি সুখী নই। শুকরিয়া আদায় করার কিছু নেই।
গোসল সেরে রান্নাঘরে ঢুকলাম। কিছু রাঁধতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রিজ থেকে রুটি, জেলী আর আপেল কুল নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখলাম। গলার স্বর সর্রোচ্চ চড়িয়ে বাপ্পীকে ডাকলাম- “খেতে এসো।”
রুটির মধ্যে জেলী মাখাতে মাখাতে বাপ্পী বলল- মিমি, কিছু কথা ছিলো।
– হুম, বলো।
– আজকে কবীর আসছে আমাদের বাসায়।
আমি ভিড়মি খেয়ে গেলাম। মুখভর্তি খাবার নিয়েই বললাম- কি বলছো এসব? কবীর আসবে মানে কি?
– তোমাকে নিতে আসবে। তোমার আপত্তি না থাকলে তুমি যেতে পারো আজ।
– কবীর বিবাহিত, বাপ্পী! আমিও।
– কবীর বিয়ে করেনি। ফেসবুকে তুমি ওর সাথে যার ছবি দেখেছো সেই মেয়েটা ওর বউ নয়। আমি তোমাকে মিথ্যে বলেছিলাম। তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকতে তোমার ফোন থেকে তোমার আইডিতে চেক করে দেখেছি তুমি ওর প্রোফাইল নিয়মিত ঘাটতে। কিন্তু ওর সাথে কথা বলতে না। সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলাম। বলেছিলাম কবীর বিয়ে করেছে। জানতাম তুমি কষ্ট পেলেও কবীরের সাথে কথা বলবে না। তোমার সাথে গত দুবছর থেকে এটা বুঝেছি তুমি তোমার বাবা-মা’র মানসম্মান বাঁচাতে আমার জন্য মরতে হলে তাও মরবে। কবীরের সাথে তুমি সে জন্যই যোগাযোগ রাখ নি।
– মিথ্যে বলেছো কেন আমাকে?
– আমি চেয়েছিলাম পারিবারিক সম্মান বাঁচাতে না, তুমি ভালবেসে আমার ঘর করো।
আমি কি ওর বিয়ে হয়নি জানলে তোমার ঘর করতাম না নাকি?
– ঘরতো তুমি মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও করবে আমার সাথে। কিন্তু ভালবাসবে অন্য কাউকে। অন্য কারো জন্য আমার প্রতি অবিচার করবে। আমি তোমাকে একতরফা ভালবাসি মিমি। আমি চেয়েছিলাম তুমিও আমাকে ভালবাসো।
– কতটুকু পেরেছো?
– পারিনি বলেই আজকে প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছি। আমি আর পারছি না। তুমি আজ চলে গেলে যেতে পার। আমি আটকাবো না।আমি জানি তুমি আমাকে মানতে পারবে না কখনোই।
খাবার ফেলে রেখে বেডরুমে চলে গেলাম। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। মনে হয় অতিরিক্ত খুশিতেই। কবীরকে পাওয়ার জন্য আমার কতোদিনের আকুতি! ওর জন্যই তো বাপ্পীকে মানতে পারিনি আমি। এতো সহজে মুক্তি পাবো বিশ্বাস হচ্ছে না।
কতোক্ষণ একরকম বসে ছিলাম জানিনা। পায়ের শব্দে ফিরে চাইলাম। কবীর আর বাপ্পী পাশাপাশি হেঁটে ঘরে ঢুকলো।
কবীরকে বসার ইঙ্গিত করে বাপ্পী বলল- কবীর, আপনি আপনার আমানত বুঝে নেন। ও আপনাকে খুউব ভালবাসে। আমি পাশের রুমে আছি। কথা শেষ হলে আমাকে ডাকবেন। আপনাদের সিদ্ধান্ত ঠিক হলে ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলবো।
আমার দিকে ফিরে হেসে বললো- ধরে নাও সেকেন্ড অ্যানিভার্সারিতে তোমার গিফট। তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
কবীর আর আমি মুখোমুখি বসে আছি। অনেকক্ষণ পর কবীর কথা বলল,
– তুমি বাপ্পীর সাথে দু’বছর একসাথে থাকলে কেন? আমার সাথে যোগাযোগ করোনি কেন?
– আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কিভাবে যোগাযোগ করবো?
– স্বামীর সাথে এক বিছানায় শোও?
– হুম।
– লজ্জা করে না তোমার?
– কবীর। এসব কথা বলার জন্য এসেছো?
– একটা লোকের সাথে দুই বছর ধরে নষ্টামি করে আসছো। তাতে কিছু না। আমি বলছি তাতেই দোষ?
– বাপ্পী আমার বর।
– ও আচ্ছা, বর! জানতাম না তো! তা বরকে ভালো লাগছে না বুঝি?
– কবীর মুখ সামলে কথা বলো।
– আমাকে ডেকেছো কেনো?
– আমি ডাকিনি। বাপ্পী ডেকেছে। আমি জানতাম না।
– তুমিতো দুধের শিশু।
– শাট আপ কবীর।
-ইউ শাট আপ। ব্লাডি হেল.. তোমার বর শালা নপুংশ একটা। বউকে কনট্রোল করতে পারে না। অন্য মানুষকে দরকার।
– কবীর। আমার বরের বাড়িতে এসে বরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বললে আমি সহ্য করবো না। You know Kabir, I love him.
Go to hell now..
– What a joke.!.
এসব উল্টাপাল্টা কথা আর নিতে পারছিলাম না। জোরে জোরে দুবার বাপ্পীকে ডাকলাম। বাপ্পী পাশের রুম থেকে ছুটে এলো। আমি বুঝতে পারছি জ্ঞান হারাবো। টলে পড়তে লাগলাম। কবীর হাত বাড়ালো ধরার জন্য। হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেলো শরীরে। লাফিয়ে উঠে গিয়ে বাপ্পীর কাঁধে আছড়ে পড়লাম। তারপর আর কিছু মনে নেই।
বাপ্পী আমার পালস ধরে বসে আছে। পাশে কবীর। কবীরের দিকে একবার চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বাপ্পীর মুখ শুকিয়ে আছে।ওকে বললাম- “ভালো আছি এখন।” ও শুকনো হাসি দিলো। ভাল লাগছে ওকে দেখতে। ভাললাগা টুকু ধরে রেখেই চোখ বন্ধ করলাম।
কবীর ধরা গলায় বলল- ভাই আমি তাহলে উঠি। আপনার বউ আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। গেলে দুবছর আপনার সাথে থাকতো না। আপনি খামোখাই আমাকে ডাকলেন। আমি কিন্তু ওকে নিয়ে যেতে আসি নি। আগামী মাসে ভিয়েনা চলে যাচ্ছি। আমি চাইনা আপনার কাছে আমি অদৃশ্য বাঁধা হয়ে থাকি। ওর বিয়ের আগেই আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল। ও আপনাকে মানতে পারেনি তার কারণ আমি না। ও মানসিকভাবে প্রস্তত ছিলো না।
বাপ্পী, আমি চুপ করে আছি। কবীর বাপ্পীর সাথে কোলাকুলি করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। বাপ্পী উঠলো দরজা দেয়ার জন্য।
ফুলের ঝুড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাপ্পী। ঝুড়ি নামিয়ে জানালার পর্দা নামালো। আমি হেসে দিয়ে বললাম- এখনতো ঘুমোচ্ছি না।
বাপ্পী পাশে এসে বসলো। আস্তে করে বলল- এখন কেমন আছো?
ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম- “ভালবাসি”।
বাপ্পী কিছুক্ষণ আমার দিকে ভাবলেষহীনভাবে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদতে শুরু করলো। ওর চোখের পানিতে আমার পিঠ ভিজে যাচ্ছে। আমিও কান্না থামাতে পারছি না। দু বছরে তিলতিল করে জমানো ভালবাসা দুজোড়া চোখ দিয়ে গড়িয়ে এসে হৃদয়ে জমা হচ্ছে..
চোখ দুজোড়া যদি সাগর হতো তবে বলতাম আজ সাগরে জলোচ্ছ্বাস উঠেছে..
_________________
মুশতারী মমতাজ মিমি।
Studied Bachelor of Medicine and Bachelor of Surgery(MBBS) at Rangpur Medical College