রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : ১৬ পয়েন্টে সক্রিয় অর্ধশতাধিক দালালচক্র
---
কক্সবাজার প্রতিনিধি : মিয়ানমারের সহিংসতার পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির কড়া তৎপরতার মধ্যেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত রয়েছে।
প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সীমান্তের অরক্ষিত ও দূর্গম অন্তত ১৬টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। আর এদের প্রবেশে সহায়তা করছে অর্ধশতাধিক দালাল। যাদের তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ প্রশাসন। এ পর্যন্ত অন্তত ৩১ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত ৩ প্লাটুন বিজিবি। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকা, সড়ক ও উপসড়কে রয়েছে পুলিশের অতিরিক্ত টহল ও নজরদারী। তারপরও থেমেই নেই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ। সীমান্তের অরক্ষিত ও দূর্গম পয়েন্ট রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করার খবর প্রতিদিনই প্রচারিত হচ্ছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যমে। পাশপাশি বিজিবি ও কোস্টগার্ডের অভিযানে প্রতিদিনই ঘটছে উখিয়া ও টেকনাফের নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টের শূণ্যরেখা থেকে অসংখ্য রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ঘটনা।
গত ২৫ নভেম্বর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কক্সবাজারে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে এসে বিজিবির মহা-পরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন টেকনাফে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে তিনিও সীমান্তের দুইপাড়ের দালাল এবং বাংলাদেশে আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে অরক্ষিত ও দূর্গম পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে গণমাধ্যমের কর্মীদের কাছে দাবি করেছিলেন।
তবে বিজিবি ও পুলিশের দাবি, সীমান্তের দূর্গম ও অরক্ষিত অংশ দিয়ে বিজিবির টহলদলের অনুপস্থিতির সুযোগে দুই দেশের দালালদের মাধ্যমে মিয়ানামারের কিছু রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখন তেমনটা নেই।
গত কয়েকদিনে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বাসিন্দা এবং ২ টি অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে ও লোকজনের সঙ্গে কথা বলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সত্যতা মিলেছে।
সীমান্তের যেসব অরক্ষিত ও দূর্গম পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটনা ঘটছে সেগুলো হল : টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হারাইঙ্গার ঘোনা, লম্বাবিল, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, মিনাবাজার, মৌলভীবাজার, হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুরা, ফুলেরডেইল, লেদা, দমদমিয়া এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের আলুরগোল্লা, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী, আঞ্জুমানপাড়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের বেতবুনিয়া, জলপাইতলী ও বাইশফারী উল্লেখযোগ্য।
সীমান্তবর্তী এসব পয়েন্টগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ছোট খাল ও নালা থাকাতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে বেশ কিছুক্ষণ সময়ক্ষেপণ হয়। এতে বিজিবির সদস্যদের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন নজরদারী করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে সীমান্তের দূর্গম ও অরক্ষিত এসব পয়েন্ট দিয়ে বিজিবির টহলের অনপুস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়ছে অনুপ্রবেশকারি রোহিঙ্গারা।
গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ৩ টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা ঘটনার পর সেনা বাহিনী সেখানে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, এ অভিযানে চলছে ধরপাকড়, হত্যা, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা। তারা প্রাণ বাঁচাতে নৌকায় করে এবং পায়ে হেঁটে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।
উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা ও ব্লক ই-১ এর চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, অনিবন্ধিত এ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৭ টি ব্লক রয়েছে। মিয়ানমারে সেনা বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউ একা, অনেকে ২/৩ জন এবং কেউবা পুরো পরিবার নিয়ে আসছেন ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে সেনা বাহিনীর অভিযান শুরুর প্রথমদিকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটনা ঘটেছে বেশি। ওই সময়ে অন্তত ৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। দলবেঁধে রোহিঙ্গারা এ সময় অনুপ্রবেশ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি কড়া পাহারা দেওয়ায় অনুপ্রবেশকারি রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আগের মতো নেই। রীতিমত টাকার বিনিময়ে দুইদেশের দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে।’
তারপরও সীমান্তের দূর্গম ও অরক্ষিত পয়েন্ট দিয়ে দালালদের সহায়তায় বিজিবির টহলদলের অনুপস্থিতির সুযোগে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান আবুল কালাম।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বান্দরবানের ঘুমধুমের বেতবুনিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমারে মংডুর পোয়াখালী এলাকার মৃত ইসলাম মিয়ার স্ত্রী আজ্জ বেগম (৫০)। সে আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে তার এক আত্মীয়ের ঘরে। কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি জানান, গত ২৪ নভেম্বর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন আমাদের এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় তারা লুটপাট ও ভাংচুর চালিয়ে পুরো পাড়ার সব বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ঘরের দরজা বন্ধ করে তার ছেলের স্ত্রী সনশিদা আক্তার (২৭) কে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সেনা বাহিনী তার এলাকার ৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
আজ্জ জানান, পোয়াখালীতে সেনাবাহিনীর অভিযানের পর পুরো এলাকা জনশূণ্য হয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে লোকজন যার যার মতো করে পালিয়ে আত্মগোপন করে। ঘটনায় মা হারা চার শিশু নাতিসহ পরিবারের ১১ সদস্যের মধ্যে ৭ জনকে নিয়ে ৬ দিন পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। এখনো পরিবারের অপর সদস্যদের কোন হদিস নেই।
তিনি জানান, বাংলাদেশী এক দালালকে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা দিয়ে বেতবুনিয়া সীমান্ত পার হয়েছেন। সীমান্ত পার হতে ওপারেও দালালদের টাকা দিতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
একই দিনে তাদের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে পুরো পরিবার নিয়ে ৬০ জনের বেশি কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন ফাতেমা আক্তার, গোলবাহার, শামসুদ্দিন, কামাল উদ্দিন ও সাইফুল ইসলাম।
শামশুদ্দিন জানান, সীমান্ত পার হতে দালালদের চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় সঙ্গে থাকা স্বর্ণের অলংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।
কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ই-ব্লকের বাসিন্দা রমজান আলী জানান, গত শুক্রবারও সীমান্ত পার হয়ে আসা শতাধিক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন।
কথা হয় গত ৩০ নভেম্বর দমদমিয়া সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের লেদার নয়াপড়া অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া মংডুর বড় গজ্জিরবিল এলাকার মৃত কালা মিয়ার ৩ মেয়ের সঙ্গে। এদের মধ্যে একজনের বয়স ১৫, আরেকজন ১৭ ও অপরজনের বয়স ২০ বছর।
তারা জানান, গত ১২ নভেম্বর মিয়ানমারের সেনা বাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন মংডুর বড় গজ্জিরবিল পাড়ায় অভিযান চালায়। এসময় তারা বাড়িতে লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে এবং যুবতীদের ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। অভিযানের দিন অন্তত ২০ থেকে ৩০ জন যুবতীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়।
‘আমরা তিন বোন তাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছি। আমাদের বাবা-মাকে সেনা বাহিনীর লোকজন বাড়িতে তালাবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের ১৩ সদস্যের মধ্যে ৯ জন এখানে আশ্রয় নিয়েছি। অপর দুইজনের এখনো কোন খোঁজ নেই। এর আগে একাধিকবার সীমান্ত পার হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলেও ১৮ দিন পর দালালদের সহযোগিতায় আসতে পেরেছি।’ বলেন তারা।
দালালদের সহযোগিতায় তাদের সঙ্গে আসা ৭ পরিবারের ৮০ জনের বেশি রোহিঙ্গা একই দিন দমদমিয়া সীমান্ত পার হয়ে নয়াপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে ধর্ষিত তিন বোন জানান।
টেকনাফের নয়াপাড়া অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বি-ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, সীমান্তে বিজিবির কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছেন। স্ব-জাতি হিসেবে তাদের আশ্রয় দিতে হচ্ছে। ক্যাম্পের প্রতিটি ঘরে অন্তত ৪/৫ জন করে রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ও শুক্রবার ভোর রাতেও অন্তত ৩ শতাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতিদিনই নির্যাতিত রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হয়ে এখানে আশ্রয় নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল হক বলেন, ‘স্থানীয় কতিপয় দালালের কারণে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়ায় দালালদের সঙ্গে স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। পরে ঘটনায় জড়িত ২ দালালকে পুলিশ আটক করেছে।’
উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী উনচিপ্রাং পয়েন্ট দিয়ে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে।’
এ ব্যাপারে বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, ‘বিজিবির অতিরিক্ত নজরদারী ও টহল জোরদার থাকার পরও সীমান্তের কয়েকটি দূর্গম পয়েন্ট দিয়ে দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করার খবর স্থানীয়দের কাছ থেকে পেয়েছি। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তার অভিযোগে বুধবার সকালে উখিয়ার বালুখালী থেকে বিজিবি ৪ দালালকে আটক করা হয়েছে।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পুলিশ সীমান্তবর্তী এলাকায় অতিরিক্ত টহল জোরদার করা হয়েছে। এসব এলাকার সড়ক ও উপ-সড়কে চলছে পুলিশের অতিরিক্ত টহল ও নজরদারী।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তাককারি দালালদের ৫১ জনের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ থেকে ৩১ জন দালালকে আটক করেছে।’ রাইজিংবিডি