রবিবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০১৮ ইং ১৬ই বৈশাখ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

বড় মধুর সেই অতীত, বড় নির্মম বর্তমান

Shahid1আশিক রহমান: একাত্তরের ২৫শে মার্চ, ভয়াল কালরাত। বর্বর পাকিস্থানী বাহিনী ঘুমন্ত শান্তিপ্রিয় বাঙালির ওপর নির্বিচারে চালায় গুলি। হায়েনাদের কামানের গোলায় পুরো ঢাকা বিধ্বস্ত হয়, গোটা বাংলাদেশ পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। বর্বর পাকিস্থানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় গোটা বাংলাদেশে শুরু হয় নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ আর নির্মম বাঙালি নিধন প্রক্রিয়া। একাত্তরের সেই চরম দু:সময়ে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারত বাংলাদেশের পাশে দাড়িয়ে প্রকৃতই বন্ধুর কাজ করেছিল। ইন্ধিরা গান্ধীর সরকার ও ভারতের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেছিল। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের সহায়তা ছিল স্বরণযোগ্য। সেসময় তাঁরা বাংলাদেশের কোটি মানুষকে নিজেদের থাকার জায়গা না থাকা সত্ত্বেও থাকার জায়গা করে দিয়েছিল, নিজেদের পেটে খাবার জুটে না তবুও সামান্য খাবারই তারা ভাগাভাগি করে খেয়েছিল। মাসের পর মাস বাংলাদেশের ঔসব অসহায় মানুষের পাশে ছিল, কোন বিরক্তি বা ক্লান্তি তাঁদের মধ্যে ছিল না, ছিল না ভালোবাসারও কোন কমতি।
হ্যা, একাত্তরের ভারত ও ভারতের জনগণের সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা বাংলাদেশ ও  বাংলাদেশের মানুষ কখনো ভুলেনি, ভুলবেও না। কারণ বাঙালি অকৃজ্ঞ-স্বার্থপর জাতি নয়, তাঁরা ভালোবাসার বিনিময় ভালোবাসা দিয়ে শোধ করায় বিশ্বাসী। তাই তাঁরা করছে, করে যাচ্ছে। বন্ধুত্ত্বের আন্তরিক হাত বাড়িয়েছে, সবসময় আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করেছে, এখনো তাই করে যাচ্ছে। বড় উদাহরণ, ভারতের সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ব্যাপক সহায়তা করেছে, এখনো করে যাচেছ। কিন্তু বর্তমান ভারত কি বাংলাদেশের সেই আন্তরিকতার কোন মূল্যায়ন করছে? সাধারণ জনগণ কিন্তু মনে করছে, না। পঁচাত্তর পরবর্তী ভারতের কথা ও কাজে কি কোন মিল আছে? সাধারণ মানুষ বলছে, প্রত্যাশিত আন্তরিকতার অভাব ভারত সরকারের মধ্যে স্পষ্ট।
     ভারতের সাথে বাংলাদেশের চারহাজার কিলোমিটারেরও অধিক দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে, যা ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের সবগুলো নদীর ওপর ন্যায্য অধিকার রয়েছে, ন্যায্য সে অধিকার ভারত সরকার বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য। গঙ্গার চুক্তি হয়েছে, তিস্তাসহ বাদবাকী নদীগুলোর কি হবে?  আশার বাণী ছাড়া কোন সদউত্তর কারো জানা নেই! 
তবে একথা সঠিক. ভারত সবসময় বাংলাদেশকে কথা দেয় যৌথনদীগুলোর ন্যায্য জল বাংলাদেশকে দিবে, কিন্তু কাজে তাঁর প্রতিফলন নেই। তাঁরা কথা দেয় সীমান্ত সিট মহলগুলোর সঠিক সমাধাণ হবে, কিন্তু এখানেও বাস্তবতা ভিন্ন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের এমপি মন্ত্রীরা সবসময় আশার বানী শুনিয়ে এসেছেন। তাঁরা কথা দেন, সীমান্তে আর কোন হত্যাকান্ড হবে না, সীমান্ত হত্যা শূণ্যে নামিয়ে আনা হবে। তাঁরা বার বার ওয়াদা করেন-কথা দেন সীমান্তে আর কোন নিরীহ নিরাপরাধ বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালাবেন না, কিন্তু তা কেবল কথার কথাই থেকে যায়। বাস্তব সত্য হলো, প্রতিদিনই সীমান্তে নির্বিচারে চলে গুলি। তাঁরা কথা দেন,  বিএসএফ এর নির্মম হত্যার স্বীকার কিশোরী ফেলানী হত্যার বিচার করা হবে। কিন্তু বিচারের নামে প্রহসণ করা হয়, ফেলানী হত্যাকারী অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ বেকসুর খালাস পায়। অন্যদিকে মমতার নির্মমতা তো রয়েছেই। তাঁকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বন্ধু মনে করেছিল, কিন্তু মমতার একগুয়েমি আর একতরফা যুক্তি বাংলাদেশকে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। মমতা এখন বাংলাদেশের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাব এমন যে, বাংলাদেশ তাঁর ন্যায্য অধিকার  চাইতেও পারবে না। ন্যায্য অধিকার চাওয়াটাও বাংলাদেশের মস্ত বড় ভুল এবং অপরাধ! 
    felani_1এখন অবশ্য উš§ুক্ত আকাশেও ভারতের কাটা তাঁরের বেড়া! ভারতের সব টেলিভিশণ চ্যানেল বাংলাদেশে দেখা গেলেও বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতের কাটা তাঁরের বেড়ায় আটকে গেছে। বাংলাদেশের কোন স্যাটেলাইট চ্যানেল ভারতের সীমানায় ঢুকতে পারে না। ফেলানীর মত কাটাতারে ঝুলে আছে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। ভারত হাইকমিশন থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের টেলিভিশণ চ্যানেল সীমান্ত পার হতে কোন বাঁধা নেই। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথাœ। নান শর্তের জালে আটকে দেয়া হয় বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। রয়েছে বিশাল বানিজ্য বৈষম্য। বিশাল এই বানিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে কিছু পদক্ষেপ যদিও বর্তমান সরকারের সময়ে নেয়া হয়েছে, যা যতসামান্যই বলা যায়। তবে উদ্যোগটি খুব প্রশংসাযোগ্য। বর্তমান সরকারের সময়ে ভারত ৪৬টি বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্ত  প্রবেশাধিকার সুবিধা দিয়েছে, ১০০ বিলিয়ন অর্থ ঋণ সহায়তা দেয়ার কথা আছে এবং এর একটি অংশ বাংলাদেশ পেয়েছে বলে গনমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বেশ উন্নতি হয়েছে এ কথা সত্য। তারপরও অনেকে বলছেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক বর্তমানে তা কোনভাবেই বন্ধুসূলভ নয়। ঠিক প্রতিবেশীমূলক আচরন ভারত বাংলাদেশের সাথে করছে না। নানা সমস্যা সংকট জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচেছ। কথা হচ্ছে এমন জোড়াতালি দিয়ে কি বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক চলে, চলতে পারে? পারে না। 

ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান সম্পর্ক কি ভারসাম্যপূণর্, নাকি অসম বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে চলছে? তিস্তার জল বন্টন, সীমান্তে হত্যাকান্ড,সাম্প্রতিক সময়ের কিশোরী ফেলানী হত্যার বিচারের রায় ও সীমান্তে চালকবিহীন ড্রোন মোতায়েন এর সংবাদ নিয়ে চারদিকে তোলপাড় চলছে, এ নিয়ে কী ভাবছেন দেশের বিশিষ্টজনরা? রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশে¬ষক এবং সাবেক নির্বাচণ কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেনের  কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কখনোই ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না, এখনোও নেই। তিস্তাসহ অভিন্ননদীগুলোর জল বন্টন, সীমান্ত হত্যাকান্ড, ফেলানী হত্যার বিচার, বিশাল বানিজ্য বৈষম্য-এর সবই বন্ধুত্ত্বের অন্তরায়। তার মধ্যে আছে ভারতের জটিল আমলাতন্ত্র, ভারতের আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতার কারণেই মূলত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক হচেছ না, প্রত্যাশিত গতি পাচ্ছে না। এর সংঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনারই এই পর্যন্ত শক্ত কোন প্রতিবাদ করতে পারেনি বাংলাদেশ, যার ফল বর্তমানে আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে  আপোসহীন হতে হবে। শান্তিপূর্ণ পথে থেকে ন্যায্য অধিকার আদায়ে তৎপর থাকা জরুরী। ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে বিরোধীদল সবার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর করাও একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের সাথে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আরো কাজ করা সময়ের দাবি। সীমান্ত হত্যাকন্ড বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভালোবাসার বিনিময় ভালোবাসাতেই হয়, গুলিতে নয়। ভালোবাসা থাকলে ভাই ভাই হিসেবে পথ চলা সহজ, এর ব্যতিক্রমে নয়। ভারতকে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবিসমূহের দিকে অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত বলেও মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। সীমান্তে বসবাসকারী সকলকে নাগরিককে সচেতন ও সর্তক্য থেকে আইনের ব্যতয় না ঘটানোর পরামর্শ দেন। 
    আর দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করেন, ভারত বাংলাদেশের জনগণের মন বুঝতে অক্ষম অথবা সব বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে। বাংলাদেশের মানুষ বোকা, এমন ভাবা ঠিক নয়। ভারত সরকারকে বুঝতে হবে, বোঝা উচিত বাংলাদেশ যা পায় তা বুঝিয়ে দেয়া। তা না হলে সম্পর্ক ভারসাম্য হারাবে। সম্পর্কে সম্মান না থাকলে সে সম্পর্কে সমস্যা দেখা দেয়, কঠিন সব সমস্যা। তাই আস্থা ও সম্পর্কে সম্মান বাড়ানো জরুরী। তাই ভারত সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করতে হবে যে, ভারত বাংলাদেশের সবসময়ের শুভাকাক্ষী। সবসময়ের বন্ধু, প্রকৃত বন্ধু।   
         
                

        

 

 

 

 

 

Print Friendly, PDF & Email