কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
---
মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
বুধবার রায়টি প্রকাশের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সেকশনে পাঠানো হয়।এর আগে রায়ে পাঁচ বিচারপতি স্বাক্ষর করেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের সাজা বাতিল করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ রায় দেন।
প্রধান বিচারপতি ছাড়াও আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
সংক্ষিপ্তভাবে দেওয়া এ রায়ে পাঁচজনের মধ্যে চারজন কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিষয়ে একমত হলেও অন্যজন দ্বিমত পোষণ করেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার করা আপিল খারিজ ও সরকারের আপিল মঞ্জুর করে এ রায় দেওয়া হয়। এ রায়ের ফলে কাদের মোল্লার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেল।
আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মামলা নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে এই প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় আপিল বিভাগে রায় হলো।
জানা গেছে, আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করবে আসামিপক্ষ।
তবে আপিল বিভাগের এ রায়ের পর আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সরকার ও আসামিপক্ষ পরস্পরবিরোধী মত প্রকাশ করেছে। সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেছেন, “এ রায়ে আমাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
তার সঙ্গে দ্বিমত ব্যক্ত করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। তারা বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের পর রিভিউ করা যাবে। কারণ, রিভিউ করা একটি সাংবিধানিক অধিকার।
রায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ছয়টি অভিযোগের সব কটিতেই সাজা দিয়েছেন আপিল বিভাগ, যদিও ট্রাইব্যুনালের রায়ে একটি অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছিলেন কাদের মোল্লা। আপিল বিভাগের রায়ে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, কবি মেহেরুন্নেসা ও তার মা-ভাইকে হত্যা এবং সাংবাদিক আবু তালেব হত্যার (অভিযোগ নম্বর ১, ২ ও ৩) দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১৫ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচরে গণহত্যার (অভিযোগ নম্বর ৪, শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা) অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে খালাস দিলেও আপিল বিভাগ এ অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া মিরপুরের আলুবদী গ্রামে গণহত্যার (৫ নম্বর অভিযোগ, ৩৪৪ ব্যক্তিকে হত্যা) দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
তবে মিরপুরে হযরত আলী, তার স্ত্রী ও সন্তানসহ পাঁচজনকে হত্যা ও মেয়েকে ধর্ষণ করার (অভিযোগ নম্বর ৬) দায়ে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ রায়ে এ সাজা বাতিল করে দিয়েছেন। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে দুটিতে তাকে যাবজ্জীবন, তিনটিতে ১৫ বছর কারাদণ্ড এবং একটিতে খালাস দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও কাদের মোল্লা পৃথক আপিল আবেদন করেন। এ আপিলের ওপর গত ২৩ জুলাই উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন।
এ আপিলের ওপর গত ১ এপ্রিল শুনানি শুরু হয়ে মোট ৩৯ কার্যদিবস শুনানি হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। এ ছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি মামলা হয় । এ মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ২৮ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ অভিযোগ গঠন করে। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করেন।